পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

একটা দীর্ঘকালের ব্যবধান আছে সেটা যদিও অর্ধেকের বেশি কেটে ফেলা হয়েছে, তবু আমার মন থেকে সেই অবশিষ্ট অংশ তাড়াতে পারছি নে। বহু দূর, বহু প্রভেদ, এবং বহু কাল, এই তিনটে ভাব এক সঙ্গে উদয় হয়ে হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে তুলছে। সাত সমুদ্র তেরাে নদী -পারবর্তী এই তিন মাসের স্বদেশবিরহকে অত্যন্ত দীর্ঘ বিরহ বলে মনে হচ্ছে।

 কিন্তু অনেকে আশঙ্কা করেন, বিরহ-নামক ব্যাপারটা সভ্যতার উপদ্রবে ভবলীলা সম্বরণ করে একান্ত কল্পনাকে প্রাপ্ত হয়েছে। কালিদাসের সময়ে যখন রেলগাড়ি ইস্টিমার পােস্ট্-আপিস ছিল তখনি খাঁটি বিরহ ছিল, এবং তখনকার দিনে বছর-খানেকের জন্য রামগিরিতে বদলি হয়ে যক্ষ যে সুদীর্ঘচ্ছন্দে বিলাপ পরিতাপ করেছিল সে তার পক্ষে অযথা হয় নি। কিন্তু স্তূপাকার তুলো যেমন কলে চেপে একটি পরিমিত গাঁঠে পরিণত হয়, সভ্যতার চাপে আমাদের সমস্তই তেমনি সংক্ষিপ্ত নিবিড় হয়ে আসছে। ছয় মাসকে যাঁতার তলায় ফেলে তিন মাসের মধ্যে ঠেসে দেওয়া হচ্ছে, পূর্বে যা মুটের মাথার বােঝা ছিল এখন তা পকেটের মধ্যে ধরে। এই সংহতির সঙ্গে সঙ্গে জীবনের সুখদুঃখ অল্প পরিসরের মধ্যে অত্যন্ত তীব্রতা প্রাপ্ত হচ্ছে। এখন ছয় মাসের বিরহ তিন মাসের মধ্যে ঘনভাবে বিরাজ করে, তাই মেঘদূতের মতাে অত বড়াে বিরহকাব্য লেখবার আর সময় পাওয়া যায় না। এখন দুই-এক পাতার মধ্যেই গীতিকাব্যের সমাপ্তি হয়; এবং বিদ্যুৎযান যখন প্রচলিত হবে তখন বিরহ এত গাঢ় হবে যে, চতুর্দশপদীও তার পক্ষে ঢিলে বােধ হবে।

 আমার অবস্থা সেই রকম। সামান্য এই কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে চলেছি, কিন্তু ভারতবর্ষ একান্ত করুণম্বরে আমাকে আহ্বান করছে।

৬৩