পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

 বলছে-বৎস, কোথায় যাস! কোন্ দূর সমুদ্রের তীরে? কোন্ যক্ষগন্ধর্বদের স্বর্ণপুরীতে? সেখানে আমার আহ্বানস্বর কি আর শুনতে পাবি?― আর যাই করিস, অবজ্ঞার ভাবে চলে যাস নে আর অবজ্ঞার ভাবে ফিরে আসিস নে। আমার দরিদ্রের ঘর, আমার কিছুই নেই, তোরা যা চাস তা সময়ে পাস নে― কিন্তু আমার ঘরে কেউ কি তোদের ভালোবাসে নি? শৈশবে কোনো নতনেত্র তোদর মুখের উপরে জাগ্রত স্নেহালোক বর্ষণ করে নি? রোগের সময় কোনো কোমল করতল তোদের তপ্ত ললাটে স্পর্শসুধা বিতরণ করে নি? ওরে অসন্তুষ্ট চঞ্চলহৃদয়, আমাকে ছেড়ে যাবার সময় কি কেবল দারিদ্র্যদুঃখই ছেড়ে গেলি, জগতের দুর্লভধন ভালোবাসা ছেড়ে গেলি নে? সেই অলকাপুরীতে কোনো দুঃস্বপ্নে যখন আমাকে মনে পড়বে তখন কি আমার স্নেহের কোল মনে পড়বে না, কেবল তার জীর্ণ চীরখানাই মনে পড়বে?

 তখন সূর্য অস্তপ্রায়। জাহাজের ছাদের উপর হালের কাছে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষের তীরের দিকে চেয়ে রইলুম। সমুত্রের জল সবুজ, তীরের রেখা নীলাভ, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সন্ধ্যা রাত্রির দিকে এবং ঞ্জাহাজ সমুদ্রের মধ্যে ক্রমশই অগ্রসর হচ্ছে। বামে বোম্বাই বন্দরের এক দীর্ঘ রেখা এখনো দেখা যাচ্ছে; দেখে মনে হল আমাদের পিতৃপিতামহের পুরাতন জননী সমুদ্রের বহুদূর পর্যন্ত ব্যাকুল বাহু বিক্ষেপ করে ডাকছেন; বলছেন, আসন্ন রাত্রিকালে অকূল সমুদ্রে অনিশ্চিতের উদ্দেশে যাস নে! এখনো ফিরে আয়!

 ক্রমে বন্দর ছাড়িয়ে গেলুম। সন্ধ্যার মেঘাবৃত অন্ধকারটি সমুদ্রের অনন্তশয্যায় দেহ বিস্তার করলে। আকাশে তারা নেই। কেবল দুরে লাইটহাউসের আলো জ্বলে উঠল; সমুদ্রের শিয়রের

৬৪