পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

রকমের একটা মুহূর্ত বলব, না এর প্রত্যেক মুহূর্তকে একটা যুগ বলব, স্থির করতে পারছি নে।

 যাইহােক, কষ্টের সীমা নেই। মানুষের মতাে এত বড় একটা উন্নত জীব যে সহসা এতটা উৎকট দুঃখ ভােগ করে তার একটা মহৎ নৈতিক কিম্বা আধ্যাত্মিক কারণ থাকাই উচিত ছিল; কিন্তু জলের উপরে কেবল খানিকটা ঢেউ ওঠার দরুন জীবাত্মার এতাধিক পীড়া নিতান্ত অন্যায় অসংগত এবং অগৌরবজনক বলে বােধ হয়। কিন্তু জাগতিক নিয়মের প্রতি দোষারােপ করে কোনাে সুখ নেই―কারণ, সে নিন্দাবাদে কারও গায়ে কিছু ব্যথা বাজে না, এবং জগৎরচনার তিলমাত্র সংশােধন হয় না।

 যন্ত্রণাশয্যায় অচেতনপ্রায় ভাবে পড়ে আছি। কখনাে কখনাে ডেকের উপর থেকে পিয়ানাের সংগীত মৃদু মৃদু কর্ণে এসে প্রবেশ করে, তখন স্মরণ হয় আমার এই সংকীর্ণ শয়নকারাগারের বাইরে সংসারের নিত্য আনন্দস্রোত সমভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। বহুদূরে ভারতবর্ষের পূর্ব সীমায় আমার সেই সংগীতধ্বনিত স্নেহমধুর গৃহ মনে পড়ে। সুখস্বাস্থ্যসৌন্দর্যময় জীবজগৎকে অতিদূরবর্তী ছায়ারাজ্যের মতাে বােধ হয়। মধ্যের এই সুদীর্ঘ মরুপথ অতিক্রম ক’রে কখন্ সেখানকার জীবন-উৎসবের মধ্যে ফিরে যেতে পারব এই কথাই কেবল ভাবি। মঙ্গলবার প্রাতে যখন শরীরের মধ্যে প্রাণটা ছাড়া আর ভৌতিক পদার্থ কিছুই অবশিষ্ট ছিল না তখন আমার বন্ধু অনেক আশ্বাস দিয়ে আমাকে জাহাজের ‘ডেক’ অর্থাৎ ছাদের উপর নিয়ে গেলেন। সেখানে লম্বা বেতের চৌকিটির উপর পা ছড়িয়ে বসে পুনর্বার এই মর্ত পৃথিবীর স্পর্শ এবং নবজীবনের আস্বাদ লাভ করা গেল।

 জাহাজের যাত্রীদের বর্ণনা করতে চাই নে। অতি নিকট হতে

৬৯