পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

কোনাে মসীলিপ্ত লেখনীর সূচ্যগ্রভাগ-যে তাদের প্রতি তীক্ষ্ণ লক্ষ স্থাপন করতে পারে এ কথা তারা স্বপ্নেও না মনে ক’রে বেশ বিশ্বস্ত চিত্তে ডেকের উপর বিচরণ করছে, টুংটাং শব্দে পিয়ানাে বাজাচ্ছে, বাজি রেখে হার-জিত খেলছে, ধূম্রশালায় বসে তাস পিটচ্ছে— তাদের সঙ্গে আমার কোনাে সম্পর্ক নেই। আমরা তিন বাঙালী তিন লম্বা চৌকিতে জাহাজের একটি প্রান্ত সম্পূর্ণ অধিকার করে অবশিষ্ট জনসংখ্যার প্রতি অত্যন্ত ঔদাস্যদৃষ্টিপাত করে থাকি।

 আমার বন্ধুর দোষগুণ সমালােচনা করতেও আমি চাই না। ত্রেতাযুগে রাজার পক্ষে প্রজারঞ্জন যেমন ছিল, কলিযুগে লেখকের পক্ষে পাঠকের মনােরঞ্জন সেই রকমের একটা পরম কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তখনকার প্রজারঞ্জনকার্যে রামভদ্র স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেছিলেন, এখনকার পাঠকরঞ্জনকার্যে লেখকদের অনেক সময়ে আত্মীয়বিচ্ছেদ ঘটে থাকে। কিন্তু স্মরণ রাখা উচিত আত্মীয়েরাও পাঠকশ্রেণীভুক্ত। অধিকাংশ সময়েই নন সে কথা সত্য, কিন্তু তাঁরা নিজে যখন বর্ণনার বিষয় হন তখন আত্মীয়রচিত প্রবন্ধও পাঠ করে থাকেন।

 কিন্তু যে বন্ধুর বর্ণনা করবামাত্র বিচ্ছেদ ঘটবার সম্ভাবনা আছে শাস্ত্রমতে তাঁকে সৎসঙ্গ বলা যায় না। অতএব আমার বন্ধু সম্বন্ধে আমি সেরকম আশঙ্কা করি নে। কিন্তু পাঠকের মনােরঞ্জনকেই যদি প্রধান উদ্দেশ্য করা যায়, তবে নিছক প্রশংসায় সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবার সম্ভাবনা নেই। নিদেন বানিয়ে দুটো নিন্দে করতে এবং শানিয়ে দুটো কথা বলতে হয়। কিন্তু সে ক্ষমতা আমার যদি থাকে আমার বন্ধুর থাকতেও আটক নেই। অতএব মৌনাবলম্বনই ভালাে।

 জাহাজে আমরা দীর্ঘদিন দুজনে মুখােমুখি চৌকি টেনে বসে

৭০