পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

সেই সনাতন মন্থনের ঘূর্ণীবেগ যে এখনাে সমুদ্রের মধ্যে রয়ে গেছে তা নরজঠরধারীমাত্রেই অনুভব করেন। যাঁরা করেন না তাঁরা বােধ করি দেবতা অথবা অসুর বংশীয়। আমার বন্ধুটিও শেষােক্ত দলের, অর্থাৎ তিনিও করেন না।

 আমি মনে মনে তাতে ক্ষুণ্ণ হয়েছিলুম। আমি যখন বিনম্রভাবে বিছানায় পড়ে পড়ে অনবরত পূর্বোক্ত শাস্ত্রীয় বর্ণনার সত্যতা সশরীরে সপ্রমাণ করছিলুম তিনি তখন স্বচ্ছন্দে আহারামােদে নিযুক্ত ছিলেন― এটা আমার চক্ষে অত্যন্ত অসাধু বলে ঠেকেছিল। শুয়ে শুয়ে ভাবতুম এক-একটা লোক আছে শাস্ত্রবাক্য ব্রহ্মবাক্যও তাদের উপর খাটে না। প্রাচীন মন্থনের সমসাময়িক কালেও যদি আমার এই বন্ধুটি সমুদ্রের কোথাও বর্তমান থাকতেন তা হলে লক্ষ্মী এবং চন্দ্রটির মত ইনিও দিব্য অনাময় সুস্থ শরীরে উপরে ভেসে উঠতেন, কিন্তু মন্থনকারী উভয় পক্ষের মধ্যে কার ভাগে পড়তেন আমি সে কথা বলতে চাই নে।

 কিন্তু বােগশয্যা ছেড়ে এখন ডেকে উঠে বসেছি, এবং শরীরের যন্ত্রণা দূর হয়ে গেছে। এখন সমুদ্র এবং আমার সঙ্গীটির সম্বন্ধে সমস্ত শাস্ত্রীয় মত এবং অশাস্ত্রীয় মনোমালিন্য সম্পূর্ণ তিরােহিত হয়েছে। এমনকি বর্তমানে আমি তাঁদের কিছু অধিক পক্ষপাতী হয়ে পড়েছি।

 এ ক’টা দিন দিনরাত্রি কেবল ডেকেই পড়ে আছি। তিলমাত্র কাল বন্ধুবিচ্ছেদ হয় নি।

 বােগ কেটে গেছে কিন্তু সম্পূর্ণ বললাভ হয় নি, শরীরের এই রকম অবস্থার মধ্যে একটু মাধুর্য আছে। এই সময়ে পৃথিবীর আকাশ, বাতাস, সূর্যালোেক, সবসুদ্ধ সমস্ত বাহ্য প্রকৃতির সঙ্গে যেন একটি নূতন পরিচয় আরম্ভ হয়। তাদের সঙ্গে আমাদের প্রতি-

৭৩