পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

 খানিকটা ভাবছি, খানিকটা লিখছি, খানিকটা ছেলেদের খেলা দেখছি। এ জাহাজে অনেকগুলি ছোটো ছােটো ছেলেমেয়ে আছে; আজকের দিনে যেটুকু চাঞ্চল্য সে কেবল তাদেরই মধ্যে। জুতাে মােজা খুলে ফেলে তারা আমাদের ডেকের উপর কমলালেবু গড়িয়ে খেলা করছে― তাদের তিনটি দাসী বেঞ্চির উপরে বসে নতমুখে নিস্তব্ধভাবে সেলাই করে যাচ্ছে, এবং মাঝে মাঝে কটাক্ষপাতে যাত্রীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে।

 বহু দূরে এক-আধটা জাহাজ দেখা যাচ্ছে। যেতে যেতে মাঝে মাঝে সমুদ্রে এক-একটা পাহাড় জেগে উঠছে— অনুর্বরকঠিন, কালো, দগ্ধতপ্ত, জনশূন্য। অন্যমনস্ক প্রহরীর মতাে সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তারা উদাসীনভাবে তাকিয়ে আছে, সামনে দিয়ে কে আসছে কে যাচ্ছে তার প্রতি কিছুমাত্র খেয়াল নেই।

 এই রকম করে ক্রমে সূর্যাস্তের সময় হল। ‘কাস্‌ল অফ ইন্‌ডোলেন্‌স্‌’ অর্থাৎ আলস্যের আলয়, কুঁড়েমির কেল্লা, যদি কাকেও বলা যায় সে হচ্ছে জাহাজ। বিশেষতঃ গরম দিনে, প্রশান্ত লোহিত সাগরের উপরে। অস্থির ইংরাজতনয়রাও সমস্ত বেলা ডেকের উপর আরামকেদারায় পড়ে ভ্রূর উপরে টুপি টেনে দিয়ে দিবাস্বপ্নে তলিয়ে রয়েছে। চলবার মধ্যে কেবল জাহাজ চলছে এবং তার দুই পাশের আহত নীল জল নাড়া পেয়ে অলস আপত্তির ক্ষীণ কলস্বরে পাশ কাটিয়ে কোনাে মতে একটুখানি মাত্র সরে যাচ্ছে।

 সূর্য অস্ত গেল। আকাশ এবং জলের উপর চমৎকার রঙ দেখা দিয়েছে। সমুদ্রের জলে একটি রেখামাত্র নেই। দিগন্তবিস্তৃত অটুট জলরাশি যৌবনপরিপূর্ণ পরিস্ফুট দেহের মতাে একেবারে নিটোল এবং সুডােল। এই অপার অখণ্ড পরিপূর্ণতা আকাশের এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্ত পর্যন্ত থম্‌থম্‌ করছে। বৃহৎ সমুদ্র হঠাৎ

৭৯