পাতা:যোগাযোগ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
যোগাযোগ

পেয়েছে। পূর্বোক্ত ছাত্রবন্ধু এসে বললে, নতুন রাজা খােশমেজাজে আছে, এই সময়ে ওর কাছ থেকে সুবিধেমতাে ধার পাওয়া যেতে পারে। তাই পাওয়া গেল— চাটুজ্যেদের সমস্ত খুচরো দেনা একঠাঁই করে এগারাে লাখ টাকা সাত পার্সেট সুদে। বিপ্রদাস হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

 কুমুদিনী ওদের শেষ অবশিষ্ট বােন বটে, তেমনি আজ ওদের সম্বলেরও শেষ অবশিষ্ট দশা। পণ জোটানাের, পাত্র জোটানাের কথা কল্পনা করতে গেলে আতঙ্ক হয়। দেখতে সে সুন্দরী, লম্বা ছিপ্‌ছিপে, যেন রজনীগন্ধার পুষ্পদণ্ড; চোখ বড়ো না হােক একেবারে নিবিড় কালাে, আর নাকটি নিখুঁত রেখায় যেন ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরি। রঙ শাঁখের মতো চিকন গৌর; নিটোল দুখানি হাত; সে-হাতের সেবা কমলার বরদান, কৃতজ্ঞ হয়ে গ্রহণ করতে হয়। সমস্ত মুখে একটি বেদনায় সকরুণ ধৈর্যের ভাব।

 কুমুদিনী নিজের জন্যে নিজে সংকুচিত। তার বিশ্বাস, সে অপয়া। সে জানে, পুরুষরা সংসার চালায় নিজের শক্তি দিয়ে, মেয়েরা লক্ষ্মীকে ঘরে আনে নিজের ভাগ্যের জোরে। ওর দ্বারা তা হল না। যখন থেকে ওর বােঝবার বয়স হয়েছে তখন থেকে চারিদিকে দেখছে দুর্ভাগ্যের পাপদৃষ্টি। আর, সংসারের উপর চেপে আছে ওর নিজের আইবুড়ো-দশা, জগদ্দল পাথর, তার যতবড়ো দুঃখ, ততবড়াে অপমান। কিছু করবার নেই, কপালে করাঘাত ছাড়া। উপায় করবার পথ বিধাতা মেয়েদের দিলেন না, দিলেন কেবল ব্যথা পাবার শক্তি। অসম্ভব একটা কিছু ঘটে না কি? কোনাে দেবতার বর, কোনাে যক্ষের ধন, পূর্বজন্মের কোনাে একটা বাকিপড়া পাওনার এক মুহূর্তে পরিশােধ? এক-একদিন রাতে বিছানা থেকে উঠে বাগানের মর্মরিত ঝাউগাছগুলাের মাথার উপরে চেয়ে থাকে, মনে-মনে বলে, “কোথায় আমার রাজপুত্র, কোথায় তােমার সাতরাজার ধন মানিক, বাঁচাও আমার ভাইদের, আমি চিরদিন তােমার দাসী হয়ে থাকব।”

১৩