পাতা:যোগাযোগ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
যোগাযোগ

 কুমু তখনই নাবার ঘরে গিয়ে কাপড় ছেড়ে শাড়ির উপর একখানা মোটা চাদর জড়িয়ে চলে এল। এখন দ্বিতীয় হুকুমের জন্যে তার অপেক্ষা। মধুসূদন দেখে বেশ বুঝলে এও রণসাজ; রাগ বেড়ে উঠল, কিন্তু কী করতে হবে ভেবে পায় না। প্রবল ক্রোধের মুখেও মধুসূদনের মনে ব্যবস্থাবুদ্ধি থাকে; তাই সে থমকে গেল। বললে, “এখন কী করতে চাও আমাকে বলো।”

 “তুমি যা বলবে তাই করব।”

 মধুসূদন হতাশ হয়ে বসে পড়ল চৌকিতে। ওই চাদরে-জড়ানো মেয়েটিকে দেখে মনে হল, এ যেন বিধবার মূর্তি—ওর স্বামী আর ওর মাঝখানে যেন একটা নিস্তব্ধ মৃত্যুর সমুদ্র। তর্জন করে এ সমুদ্র পার হওয়া যায় না। পালে কোন্ হাওয়া লাগলে তরী ভাসবে? কোনো দিন কি ভাসবে?

 চুপ করে বসে রইল। ঘড়ির টিক টিক শব্দ ছাড়া ঘরে একটুও শব্দ নেই। কুমুদিনী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল না—আবার ফিরে বাইরে ছাতের অন্ধকারের দিকে চোখ মেলে ছবির মতো দাঁড়িয়ে রইল। রাস্তার মোড় থেকে একটা মাতালের গদ্‌গদ কণ্ঠের গানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, আর প্রতিবেশীর আস্তাবলের একটা কুকুরের বাচ্ছাকে বেঁধে রেখেছে, রাত্রির শান্তি ঘুলিয়ে দিয়ে উঠছে তারই অশ্রান্ত আর্তনাদ।

 সময় একটা অতলস্পর্শ গর্তের মতো শূন্য হয়ে যেন হাঁ করে আছে। মধুসূদনের সংসারের কলের সমস্ত চাকাই যেন বন্ধ। কাল তার আপিসের অনেক কাজ, ডাইরেকটারদের মীটিং,—কতকগুলো কঠিন প্রস্তাব অনেকের বাধা সত্ত্বেও কৌশলে পাস করিয়ে নিতে হবে। সে-সমস্ত জরুরি ব্যাপার আজ তার কাছে একেবারে ছায়ার মতো। আগে

১৫৪