পাতা:যোগাযোগ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
যোগাযোগ

খাঁচায় বন্দী করা হয়েছিল, আজ যেন দরজা একটু ফাঁক করতেই সে উড়ে পড়ল, আর যেন এ-খাঁচায় সে ঢুকবে না।

 নবীন বললে, “বউরানী, ফিরে আসতে দেরি কোরো না, এই কথাটা সব মন দিয়ে বলতে পারলে বেঁচে যেতুম, কিন্তু মুখ দিয়ে বেরােল না। যাদের কাছে তােমার যথার্থ সম্মান সেইখানেই তুমি থাকো গে। কোনাে কালে নবীনকে যদি কোনাে কারণে দরকার হয় স্মরণ করাে।”

 মােতির মা নিজের হাতে তৈরি আমসত্ত্ব আচার প্রভৃতি একটা হাঁড়িতে সাজিয়ে পালকিতে তুলে দিলে। বিশেষ কিছু বললে না। কিন্তু মনে তার বেশ একটু আপত্তি ছিল। যতদিন বাধা ছিল স্থূল, যতদিন মধুসূদন কুমুকে বাহির থেকে অপমান করেছে, মােতির মার সমস্ত মন ততদিন ছিল কুমুর পক্ষে; কিন্তু যে-বাধা সুক্ষ্ম, যা মর্মগত, বিশ্লেষণ করে যার সংজ্ঞা নির্ণয় করা কঠিন, তারই শক্তি যে প্রবলতম, এ-কথাটা মােতির মার কাছে সহজ নয়। স্বামী যে-মুহূর্তে প্রসন্ন হবে সেই মুহূর্তে অবিলম্বে স্ত্রী সেটাকে সৌভাগ্য বলে গণ্য করবে, মােতির মা এইটেকেই স্বাভাবিক বলে জানে। এর ব্যতিক্রমকে সে বাড়াবাড়ি মনে করে। এমন কি, এখনাে যে বউরানী সম্বন্ধে নবীনের দরদ আছে, এটাতে তার রাগ হয়। কুমুর প্রকৃতিগত বিতৃষ্ণা যে একান্ত অকৃত্রিম, এটা যে অহংকার নয়, এমনকি এইটে নিয়ে যে কুমুর নিজের সঙ্গে নিজের দুর্জয় বিরােধ, সাধারণত মেয়েদের পক্ষে এটা স্বীকার করে নেওয়া কঠিন। যে চীনে মেয়ে প্রথার অনুসরণে নিজের পা বিকৃত করতে আপত্তি করে নি, সে যদি শােনে জগতে এমন মেয়ে আছে যে আপনার এই পদসংকোচ-পীড়নকে স্বীকার করা অপমানজনক বলে মনে করে, তবে নিশ্চয় সেই কুণ্ঠাকে সে হেসে উড়িয়ে দেয়, নিশ্চয় বলে ওটা ন্যাকামি। যেটা নিগুঢ়ভাবে স্বাভাবিক সেইটেকেই সে জানে অস্বাভাবিক। মােতির মা একদিন কুমুর দুঃখে সব-চেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছিল, বােধ করি

২২৭