পাতা:যোগাযোগ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
যোগাযোগ

দাঁড়িয়ে— অল্প করে ডুবছে। ক্রিয়াকর্ম সংক্ষেপ ও চালচলন খাটো না করলে উপায় নেই। কুমুর বিয়ে নিয়েও কেবলই প্রশ্ন আসে, তার উত্তর দিতে মুখে বাধে। শেষকালে নুরনগর থেকে বাসা তুলতে হল। কলকাতায় বাগবাজারের দিকে একটা বাড়িতে এসে উঠল।

 পুরােনাে বাড়িতে কুমুদিনীর একটা প্রাণময় পরিমণ্ডল ছিল। চারিদিকে ফুলফল, গােয়ালঘর, পূজোবাড়ি, শস্যখেত, মানুষজন। অন্তঃপুরের বাগানে ফুল তুলেছে, সাজি ভরেছে, নুন-লঙ্কা-ধনেপাতার সঙ্গে কাঁচা কুল মিশিয়ে অপথ্য করেছে, চালতা পেড়েছে, বােশেখ-জষ্টির ঝড়ে আমবাগানে আম কুড়িয়েছে। বাগানের পূর্বপ্রান্তে ঢেঁকিশাল, সেখানে লাড়ুকোটা প্রভৃতি উপলক্ষ্যে মেয়েদের কলকোলাহলে তারও অল্প কিছু অংশ ছিল। শ্যাওলায়-সবুজ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা খিড়কির পুকুর, ঘন ছায়ায় স্নিগ্ধ, কোকিল-ঘুঘু-দোয়েল-শ্যামার ডাকে মুখরিত। এইখানে প্রতিদিন সে জলে কেটেছে সাঁতার, নালফুল তুলেছে, ঘাটে বসে দেখেছে খেয়াল, আনমনে একা বসে করেছে পশম সেলাই। ঋতুতে ঋতুতে মাসে মাসে প্রকৃতির উৎসবের সঙ্গে মানুষের এক-একটি পরব বাঁধা; অক্ষয় তৃতীয়া থেকে দোলযাত্রা বাসন্তীপূজো পর্যন্ত কত কী। মানুষে প্রকৃতিতে হাত মিলিয়ে সমস্ত বছরটিকে যেন নানা কারুশিল্পে বুনে তুলছে। সবই যে সুন্দর, সবই যে সুখের তা নয়। মাছের ভাগ, পূজোর পার্বণী, কত্রীর পক্ষপাত, ছেলেদের কলহে স্ব-স্ব ছেলের পক্ষসমর্থন প্রভৃতি নিয়ে নীরবে ঈর্ষা বা তারস্বরে অভিযােগ, কানে কানে পরচর্চা বা মুক্তকণ্ঠে অপবাদঘােষণা এ-সমস্ত প্রচুর পরিমাণেই আছে— সব-চেয়ে আছে নিত্যনৈমিত্তিক কাজের ব্যস্ততার ভিতরে ভিতরে নিয়ত একটা উদ্বেগ— কর্তা কখন কী করে বসেন, তাঁর বৈঠকে কখন কী দুর্যোগ আরম্ভ হয়। যদি আরম্ভ হল তবে দিনের পরে দিন শান্তি নেই। কুমুদিনীর বুক দুর্ দুর্ করে, ঘরে লুকিয়ে

২৫