পাতা:যোগাযোগ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
যোগাযোগ

ঠোঁট চাপা, চিবুক ভারি। কড়া চুল কাফ্রিদের মতাে কোঁকড়া, মাথার তেলাে ঘেঁষে ছাটা। খুব আঁটসাঁট শরীর; যত বয়েস তার চেয়ে __ বােধ হয়, কেবল দুই রগের কাছে চুলে পাক ধরেছে। বেঁটে, মাথায় প্রায় কুমুদিনীর সমান। হাত দুটো রােমশ ও দেহের তুলনায় খাটো। সবসুদ্ধ মনে হয় মানুষটা একেবারে নিরেট; মাথা থেকে পা পর্যন্ত সর্বদাই কী একটা প্রতিজ্ঞা যেন গুলি পাকিয়ে আছে। যেন ভাগ্যদেবতার কামান থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে একাগ্রভাবে চলেছে একটা একগুঁয়ে গােলা। দেখলেই বােঝা যায় বাজে কথা বাজে বিষয় বাজে মানুষের প্রতি মন দেবার ওর একটুও অবকাশ নেই।

 বিবাহটা এমন ভাবে হল যে, সকলেরই মনে খারাপ লাগল। বরপক্ষকন্যাপক্ষের প্রথম সংস্পর্শমাত্রই এমন একটা বেসুর ঝনঝনিয়ে উঠল যে, তার মধ্যে উৎসবের সংগীত কোথায় গেল তলিয়ে। থেকে-থেকে কুমুর মনের একটা প্রশ্ন অভিমানে বুক ঠেলে ঠেলে উঠছে, “ঠাকুর কি তবে আমাকে ভােলালেন?” সংশয়কে প্রাণপণে চাপা দেয়, রুদ্ধঘরের মধ্যে একলা বসে বারবার মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলে, মন যেন দুর্বল না হয়। সবচেয়ে কঠিন হয়েছে দাদার কাছে সংশয় লুকোনো।

 মায়ের মৃত্যুর পর থেকে কুমুদিনীর সেবার ’পরেই বিপ্রদাসের একান্ত নির্ভর। কাপড়চোপড়, দিনখরচের টাকাকড়ি, বইয়ের আলমারি, ঘােড়ার দানা, বন্দুকের সম্মার্জন, কুকুরের সেবা, ক্যামেরার রক্ষণ, সংগীতযন্ত্রের পর্যবেক্ষণ, শােবার বসবার ঘরের পারিপাট্যসাধন,—সমস্ত কুমুর হাতে। এত বেশি অভ্যাস হয়ে এসেছে যে, প্রাত্যহিক ব্যবহারে কুমুর হাত কোথাও না থাকলে তার রােচে না। সেই দাদার রােগশয্যায় বিদায়ের আগে শেষ কয়দিন যে-সেবা করতে হয়েছে তার মধ্যে নিজের ভাবনার কোনাে ছায়া না পড়ে এই তার দুঃসাধ্য চেষ্টা। কুমুর এসরাজের

৫৬