পাতা:যোগাযোগ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
যোগাযোগ

হাত নিয়ে বিপ্রদাসের ভারি গর্ব। লাজুক কুমু সহজে বাজাতে চায় না। এই দুদিন সে আপনি যেচে দাদাকে কানাড়া-মালকোষের আলাপ শুনিয়েছে। সেই আলাপের মধ্যেই ছিল তার দেবতার স্তব, তার প্রার্থনা, তার আশঙ্কা, তার আত্মনিবেদন। বিপ্রদাস চোখ বুজে চুপ করে শোনে আর মাঝে মাঝে ফরমাশ করে—সিন্ধু, বেহাগ, ভৈরবী— যে-সব সুরে বিচ্ছেদ-বেদনার কান্না বাজে। সেই সুরের মধ্যে ভাইবোন দুজনেরই ব্যথা এক হয়ে মিশে যায়। মুখের কথায় দুজনে কিছুই বললে না; না দিলে পরস্পরকে সান্ত্বনা, না জানালে দুঃখ।

 বিপ্রদাসের জ্বর কাশি বুকে ব্যথা সারল না, বরং বেড়ে উঠছে। ডাক্তার বলছে ইনফ্লুয়েঞ্জা, হয়তো ন্যুমোনিয়ায় গিয়ে পৌঁছতে পারে, খুব সাবধান হওয়া চাই। কুমুর মনে উদ্বেগের সীমা নেই। কথা ছিল বাসি-বিয়ের কালরাত্রিটা এখানেই কাটিয়ে দিয়ে পরদিন কলকাতায় ফিরবে। কিন্তু শোনা গেল মধুসূদন হঠাৎ পণ করেছে, বিবাহের পরদিনে ওকে নিয়ে চলে যাবে। বুঝলে, এটা প্রথার জন্যে নয়, প্রয়োজনের জন্যে নয়, প্রেমের জন্যে নয়, শাসনের জন্যে। এমন অবস্থায় অনুগ্রহ দাবি করতে অভিমানিনীর মাথায় বজ্রাঘাত হয়। তবু কুমু মাথা হেঁট করে লজ্জা কাটিয়ে কম্পিতকণ্ঠে বিবাহের রাতে স্বামীর কাছে এইমাত্র প্রার্থনা করেছিল যে, আর দুটো দিন যেন তাকে বাপের বাড়িতে থাকতে দেওয়া হয়, দাদাকে একটু ভালো দেখে যেন সে যেতে পারে। মধুসূদন সংক্ষেপে বললে, “সমস্ত ঠিকঠাক হয়ে গেছে।” এমন বজ্রে-বাঁধা একপক্ষের ঠিকঠাক, তার মধ্যে কুমুর মর্মান্তিক বেদনারও এক তিল স্থান নেই। তার পর মধুসূদন ওকে রাত্রে কথা কওয়াতে চেষ্টা করেছে, ও একটিও জবাব দিল না—বিছানার প্রান্তে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে রইল।

৫৭