পাতা:যোগাযোগ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
যোগাযোগ

 “আমাকে আশীর্বাদ করাে, দাদা, আমাকে আশীর্বাদ করো,” বলে কুমু দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্না চাপা দিলে।

 বিপ্রদাস বালিশে ঠেস দিয়ে একটু উঠে বসে কুমুর মুখ নামিয়ে ধরে তার মাথায় চুমাে খেলে।

 ডাক্তার ঘরে ঢুকে বললে, “আর নয়, কুমুদিদি, এখন ওর একটু শান্ত থাকা দরকার।”

 কুমু রােগীর বালিশ একটু চেপে-চুপে ঠিক করে গায়ের উপর গরম কাপড়টা টেনে দিয়ে, পাশের টিপাইটার উপরকার বিশৃঙ্খলতা একটু সেরে নিয়ে দাদার কানের কাছে মৃদুস্বরে বললে, “সেরে গেলেই কলকাতায় যেয়াে দাদা, সেখানে তােমাকে দেখতে পাব।”

 বিপ্রদাস বড়াে বড়ো দুই স্নিগ্ধ চোখ কুমুর মুখের উপর স্থির রেখে বললে, “কুমু পশ্চিমের মেঘ যায় পুবে, পুবের মেঘ যায় পশ্চিমে, এ-সব হাওয়ায় হয়। সংসারে সেই হাওয়া বইছে। মেঘের মতােই অমনি সহজে এটাকে মেনে নিস দিদি। এখন থেকে আমাদের কথা বেশি ভাবিস নে। যেখানে যাচ্ছিস সেখানে লক্ষ্মীর আসন ওই জুড়ে থাকিস—এই আমার সকল মনের আশীর্বাদ। তাের কাছে আমরা আর কিছুই চাই নে।”

 দাদার পায়ের কাছে কুমু মাথা রেখে পড়ে রইল। “আজ থেকে আমার কাছে আর কিছুই চাবার নেই। এখানকার প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় আমার কোনাে হাতই থাকবে না”—এক মুহূর্তে এতবড় বিচ্ছেদের কথা মনে মেনে নেওয়া যায় না। ঝড়ে যখন নৌকাকে ডাঙা থেকে টেনে নিয়ে যায় তখন নােঙর যেমন করে মাটি আঁকড়ে থাকতে চায়, দাদার পায়ের কাছে কুমুর তেমনি এই শেষ ব্যগ্রতার বন্ধন। ডাক্তার আবার এসে ধীরে ধীরে বললে, “আর নয় দিদি।” বলে নিজের

৬০