পাতা:রক্তকরবী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(: Q 3) রাজা পাতালে সুড়ঙ্গ খোদাই ক’রে সেই ধন হরণে নিযুক্ত। তাই আদর করে এই পুরীকে সমঝদার লোকেরা যক্ষপুরী বলে। লক্ষ্মীপুরী কেন বলে না ? কারণ, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বৈকুষ্ঠে, যক্ষের ভাণ্ডার পাতালে । রামায়ণের গল্পের ধারার সঙ্গে এর যে একটা মিল দেখছি তার কারণ এ নয় যে, রামায়ণ থেকে গল্পটি আহরণ করা। আসল কারণ, কবিগুরুই আমার গল্পটিকে ধ্যানযোগে আগে থাকতে হরণ করেছেন। যদি বলো প্রমাণ কি ? প্রমাণ এই যে, স্বৰ্ণলঙ্কা তার কালে এমন উচ্চচুড়া নিয়ে প্রকাশমান ছিল কেউ তা মানবে না। এটা যে বর্তমানকালেরই, হাজার জায়গায় তার প্রমাণ প্রত্যক্ষ হ'য়ে আছে । ধ্যানের সিদ্ধ কেটে মহাকবি ভাবীকালের সামগ্রীতে কি রকম কৌশলে হস্তক্ষেপ করতেন তার আর একটি প্রমাণ দেব । কর্ষণজীবী এবং আকর্ষণজীবী এই দুই জাতীয় সভ্যতার মধ্যে একটা বিষম দ্বন্দ্ব আছে, এ সম্বন্ধে বন্ধুমহলে আমি প্রায়ই আলাপ করে থাকি। কৃষিকাজ থেকে হরণের কাজে মানুষকে টেনে নিয়ে কলিযুগ কৃষিপল্লীকে কেবলি উজাড় করে দিচ্চে। তা ছাড়া, শোষণজীবী সভ্যতার ক্ষুধাতৃষ্ণা দ্বেষ হিংসা বিলাস বিভ্ৰম সুশিক্ষিত রাক্ষসেরই মতো। আমার মুখের এই রচনাটি কবি তাঁর রূপকের বুলিতে লুকিয়ে আত্মসাৎ করেছেন সেটা প্রণিধান করলেই বোঝা যায়। নবদূৰ্ব্বাদলশ্যাম রামচন্দ্রের বক্ষসংলগ্ন সীতাকে স্বর্ণপুরীর অধীশ্বর দশানন হরণ ক’রে নিয়েছিলেন সেটা কি সেকালের কথা, না একালের ? সেটা কি ত্রেতাযুগের ঋষির কথা, না আমার মতো কলিযুগের কবির কথা ? তখনো কি সোনার খনির মালেকরা নবদূর্বাদলবিলাসী কৃষকদের ঝুঁটি ধরে টান দিয়েছিল ? আরো একটা কথা মনে রাখতে হবে। কৃষী যে দানবীয় লোভের টানেই আত্মবিস্মৃত হচ্ছেত্রেতাযুগে তারই বৃত্তান্তটি গা-ঢাকা দিয়ে বলবার জন্যেই সোনার মায়ামৃগের বর্ণনা আছে। আজকের দিনের রাক্ষসের মায়ামৃগের লোভেই তো আজকের দিনের সীতা তার হাতে ধরা পড়ছে নইলে গ্রামের পঞ্চবটচ্ছায়া শীতল এ সমস্তই পরবর্তী কালের অর্থাৎ পরস্ব । বারোয়ারীর প্রবীণমণ্ডলীর কাছে একথা বলে ভালো করলেম না। সীতাচরিত প্রভৃতি পুণ্যকথা সম্বন্ধে তাঁরা আমাকে অশ্রদ্ধাবান বলেই সন্দেহ করেন । এটা আমার দোষ নয়, তাদেরও দোষ বলতে পারিনে, বিধাতা তাদের এই রকমই বুদ্ধি দিয়েছেন। বোধ করি সেটা আমার সঙ্গে বারে বারে কৌতুক করবার জন্যেই। পুণ্যশ্লোক বাল্মীকির প্রতি কলঙ্ক আরোপ করলুম বলে পুনর্বার হয়তো তারা আমাকে একঘরে করবার চেষ্টা করবেন । ভরসার কথা আমার দলের লোক আছেন, কৃত্তিবাস নামে আর এক বাঙালি কবি । এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে উঠল। আধুনিক সমস্যা বলে কোনো পদার্থ নেই, মানুষের সব গুরুতর সমস্যাই চিরকালের। রত্নাকরের গল্পটার মধ্যে তারই প্রমাণ পাই। রত্নাকর গোড়ায় ছিলেন দস্য, তার পরে দসু্যুবৃত্তি ছেড়ে ভক্ত হলেন রামের । অর্থাৎ ধর্ষণ বিদ্যার প্রভাব এড়িয়ে কর্ষণ বিদ্যায় যখন দীক্ষা নিলেন তখনই সুন্দরের আশীর্বাদে তাঁর বীণা বাজল। এই তত্ত্বটা তখনকার দিনেও লোকের মনে জেগেছে। এক কালে যিনি দস্য ছিলেন তিনিই যখন কবি হলেন তখনই আরণ্যকদের হাতে স্বর্ণলঙ্কার পরাভবের বাণী তাঁর কষ্ঠে এমন জোরের সঙ্গে বেজেছিল । হঠাৎ মনে হতে পারে রামায়ণটা রূপক কথা। বিশেষত যখন দেখি রাম