পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অচলিত) দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/১৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৩২ রবীন্দ্র-রচনাবলী শুনিয়া আমাদের মনে হয় যে, বাঙ্গালী জাতির যথার্থ ভাষাটি যে কি, তাহা আমরা সকলে ঠিক ধরিতে পারি নাই—বাঙ্গালী জাতির প্রাণের মধ্যে ভাবগুলি কিরূপ আকারে অবস্থান করে, তাহা আমরা ভাল জানি না। এই নিমিত্ত আধুনিক বাঙ্গালা ভাষায় সচরাচর যাহা কিছু লিখিত হইয়া থাকে, তাহার মধ্যে যেন একটি খাটি বিশেষত্ব দেখিতে পাই না। পড়িয়া মনে হয় না, বাঙ্গালীতেই ইহা লিখিয়াছে, বাঙ্গালাতেই ইহা লেখা সম্ভব, এবং ইহা অন্য জাতির ভাষায় অনুবাদ করিলে তাহারা বাঙ্গালীর হৃদয়-জাত একটি নূতন জিনিষ লাভ করিতে পারিবে। ভাল হউক মন্দ হউক আজকাল যে সকল লেখা বাহির হইয়া থাকে, তাহা পড়িয়া মনে হয় যেন এমন লেখা ইংরাজিতে বা অন্যান্য ভাষায় সচরাচর লিখিত হইয়া থাকে বা হইতে পারে । ইহার প্রধান কারণ, এখনো আমরা বাঙ্গালীর ঠিক ভাবটি, ঠিক ভাষাটি ধরিতে পারি নাই ! সংস্কৃতৰাগীশের বলিবেন, ঠিক কথা বলিয়াছ, আজকালকার লেখায় সমাস দেখিতে পাই না, বিশুদ্ধ সংস্কৃত কথার অাদর নাই, এ কি বাঙ্গালা ! আমরা তাহাদের বলি, তোমাদের ভাষাও বাঙ্গালা নহে, আর ইংরাজিওয়ালাদের ভাষাও বাঙ্গালা নহে। ংস্কৃত ব্যাকরণেও বাঙ্গালা নাই, আর ইংরাজি ব্যাকরণেও বাঙ্গালা নাই, বাঙ্গালা ভাষা বাঙ্গালীদের হৃদয়ের মধ্যে আছে । ছেলে কোলে করিয়া সহরময় ছেলে খুজিয়া বেড়ান যেমন, তোমাদের ব্যবহারও তেমনি দেখিতেছি । তোমরা বাঙ্গালা বাঙ্গালা করিয়া সৰ্ব্বত্র খুজিয়া বেড়াইতেছ, সংস্কৃত ইংরাজি সমস্ত ওলট-পালট্‌ করিতেছ, কেবল একবার হৃদয়টার মধ্যে অনুসন্ধান করিয়া দেখ নাই। আমাদের সমালোচ্য গ্রন্থে একটি গান আছে— “আমি কে তাই আমি জানলেম না, আমি আমি করি কিন্তু, আমি আমার ঠিক হইল না । কড়ায় কড়ায় কড়ি গণি, চার কড়ায় এক গণ্ডা গণি কোথা হইতে এলাম আমি, তারে কই গণি !” আমাদের ভাব, আমাদের ভাষা আমরা যদি আয়ত্ত করিতে চাই, তবে বাঙ্গালী যেখানে হৃদয়ের কথা বলিয়াছে, সেইখানে সন্ধান করিতে হয় । যাহাদের প্রাণ বিদেশী হইয়া গিয়াছে, তাহারা কথায় কথায় বলেন—ভাব সৰ্ব্বত্রই সমান। জাতি-বিশেষের বিশেষ সম্পত্তি কিছুই নাই। কথাটা শুনিতে বেশ উদার, প্রশস্ত। কিন্তু আমাদের মনে একটি সন্দেহ আছে। আমাদের মনে হয়, যাহার নিজের কিছু নাই, সে পরের স্বত্ব লোপ করিতে চায়। উপরে যে মতটি প্রকাশিত