পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অচলিত) দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/১৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমালোচন৷ Ꮌ © Ꮔ ভাবের এত বল কেন ? কারণ, ভাব অত্যন্ত বৃহৎ । বুদ্ধি বিবেচনার ন্যায় সীমাবদ্ধ নহে । লাভ ক্ষতির মধ্যে তাহার পরিধির শেষ নহে—বস্তুর মধ্যে সে রুদ্ধ নহে। তাহার নিজের মধ্যেই তাহার নিজের অসীমতা । সম্মুখে যখন মৃত্যু আসে তখনও সে অটল, কারণ ক্ষুদ্র জীবনের অপেক্ষ ভাব বৃহৎ । সম্মুখে যখন সৰ্ব্বনাশ উপস্থিত তখনও সে বিমুখ হয় না, কারণ লাভের অপেক্ষাও ভাব বৃহৎ । স্ত্রী পুত্র পরিবার ভাবের নিকট ক্ষুদ্র হইয়া যায়। আমাদের জাতি নূতন হাটিতে শিখিতেছে, এ সময়ে বৃদ্ধ জাতির দৃষ্টাস্ত দেখিয়া ভাবের প্রতি ইহার অবিশ্বাস জন্মাইয়া দেওয়া কোন মতেই কৰ্ত্তব্য বোধ হয় না । এখন ইতস্ততঃ করিবার সময় নহে। এখন ভাবের পতাকা আকাশে উড়াইয়া নবীন উৎসাহে জগতের সমরক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে হইবে। এই বাল্য-উৎসাহের স্মৃতিই বৃদ্ধ সমাজকে সতেজ করিয়া রাখে। এই সময়ে ধৰ্ম্ম, স্বাধীনতা, বীরত্বের যে একটি অখণ্ড পরিপূর্ণ ভাব হৃদয়ে জাজ্জল্যমান হইয়া উঠে, তাহারই সংস্কার বৃদ্ধকাল পর্য্যস্ত স্থায়ী হয় । এখনি যদি হৃদয়ের মধ্যে ভাঙ্গা-চোরা টলমল অসম্পূর্ণ প্রতিমা, তবে উত্তরকালে তাহার জীর্ণ ধূলি মাত্র অবশিষ্ট থাকিবে । জীবনের আদর্শকে সীমাবদ্ধ করিয়া কখনই জাতির উন্নতি হইবে না । উদারতা নহিলে কখনই মহত্ত্বের স্ফুর্তি হইবে না। মুখশ্ৰীতে যে একটি দীপ্তির বিভাস হয়, হৃদয়ের মধ্যে যে একটি প্রতিভার বিকাশ হয়, সমস্ত জীবন যে সংসার-তরঙ্গের মধ্যে অটল আচলের ন্যায় মাথা তুলিয়া জাগিয়া থাকে, সে কেবল একটি বিপুল উদারতাকে আশ্রয় করিয়া। সঙ্কোচের মধ্যে গেলেই রোগে জীৰ্ণ, শোকে শীর্ণ, ভয়ে ভীত, দাসত্বে নতশির, অপমানে নিরুপায় হইয়া থাকিতে হয়, চোখ তুলিয়া চাহিতে পারা যায় না, মুখ দিয়া কথা বাহির হয় না, কাপুরুষতার সমস্ত লক্ষণ প্রকাশ পায়। তখন মিথ্যাচরণ, কপটতা, তোষামোদ জীবনের সম্বল হইয়া পড়ে ।