পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অচলিত) দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/২৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२२२ । । ররীন্দ্র-রচনাবলী মানিয়া লইলেও এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে যে, জলের উপর দিয়া পদব্রজে চলা সহজ নহে—সেখানে তদপেক্ষা সস্তরণ সহজ । অপ্রত্যক্ষ পদার্থকে মনন দ্বারা জানা অপেক্ষা প্রত্যক্ষ পদার্থকে চক্ষু দ্বারা দেখা সহজ একথা স্বীকাৰ্য্য কিন্তু তাই বলিয়া অতীন্দ্রিয় পদার্থকে চক্ষু দ্বারা দেখা সহজ নহে—এমন কি, তাহা অসাধ্য। তেমনি সাকার মূৰ্ত্তির রূপ ধারণা সহজ সন্দেহ নাই কিন্তু সাকার মূৰ্ত্তির সাহায্যে ব্রহ্মের ধারণা একেবারেই অসাধ্য, কারণ, স বৃক্ষকালাকৃতিভি: পরোহন্তঃ তিনি সংসার হইতে কাল হইতে সাকার পদার্থ হইতে শ্রেষ্ঠ এবং ভিন্ন এবং সেই জন্যই তাহাতে সংসারাতীত দেশকালাতীত শিবং শান্তিমত্যস্তমেতি অত্যন্ত মঙ্গল এবং অত্যন্ত শান্তিলাভ হয় ; অথচ র্তাহাকে পুনশ্চ আকৃতির মধ্যে বদ্ধ করিয়া ধারণা করিবার চেষ্টা এত কঠিন যে তাহ অসাধ্য, অসম্ভব, তাহা স্বতোবিরোধী । কিন্তু সহজ কঠিনের কথা উঠে কেন ? আমরা সহজ চাই, না সত্য চাই ? সত্য যদি সহজ হয় ত ভাল, যদি না হয় তবু সত্য বই গতি নাই। পৃথিবী কুষ্মের পৃষ্ঠে প্রতিষ্ঠিত আছে এ কথা ধারণা করা যদি কাহারও পক্ষে সহজ হয়, তথাপি বিজ্ঞানপিপাস্থ সত্যের মুখ চাহিয় তাহাকে অশ্রদ্ধেয় বলিয়া অবজ্ঞা করেন । মরু-প্রাস্তরের মধ্যে ভ্ৰাম্যমাণ ক্ষুধাৰ্ত্ত যখন অন্ন চায়, তখন তাহাকে বালুকাপিণ্ড আনিয়া দেওয়া সহজ—কিন্তু সে বলে আমি ত সহজ চাই না, আমি অন্নপিণ্ড চাই—সে অল্প এখানে যদি না পাওয়া যায়, তবে দুরূহ হইলেও তাহাকে অন্যত্র হইতে আহরণ করিতে হইবে, নহিলে আমি বঁাচিব না । তেমনি সংসার মধ্যে আমরা যখন অধ্যাত্ম-পিপাসা মিটাইতে চাই তখন কল্পনা-মরীচিকায় সে কিছুতেই মিটে না—যত দুর্লভ হউক সেই পিপাসার জল—আত্মার একমাত্র আকাঙ্ক্ষণীয় পরমাত্মাকেই চাই—তিনি নিরাকার নির্বিবকার বাক্যমনের অগোচর হইলেও তবু তাহাকেই চাই, নহিলে আমাদের মুক্তি নাই । ধৰ্ম্মপথ ত সহজ নহে, ব্ৰহ্মলাভ ত সহজ নহে, সে কথা সকলেই বলে—দুর্গং পথস্তং কবয়ো বদস্তি—সেই জন্যই মোহনিদ্রাগ্রস্ত সংসারীর দ্বারে দাড়াইয়া ঋষি উচ্চস্বরে ডাকিতেছেন—“উত্তিষ্ঠত, জাগ্ৰত”—না উঠিলে না জাগিলে এই ক্ষুরধার-নিশিত দুর্গম দুরত্যয় পথে চক্ষু মুদিয়া চলা যায় না, আত্মার অভাব আলস্যভরে অনায়াসে মোচন হয় না—এবং ব্রহ্ম ক্রীড়াচ্ছলে কল্পনাবাহিত মনোরথের গম্য নহেন । সংসারে যদি বিদ্যালাভ, বিত্তলাভ, যশোলাভ সহজ না হয়,—তবে ধৰ্ম্মলাভ, সত্যলাভ, ব্ৰহ্মলাভ সহজ, এমন আশ্বাস কে দিবে এবং সে আশ্বাসে কে ভুলিবে! কোন মূঢ় বিশ্বাস করিবে যে, মস্ত্ৰোচ্চারণে লোহা সোনা হইয়া যাইবে, খনি অন্বেষণের প্রয়োজন নাই ? উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত । দুর্গং পথস্তং কবয়ো বদস্তি !