পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অচলিত) দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/২৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঔপনিষদ ব্রহ্ম ২১৩ তবে ব্ৰহ্মলাভের চেষ্টা কি একেবারে পরিত্যাগ করিতে হইবে ? তবে কি এই কথা বলিয়া মনকে বুঝাইতে হইবে যে, র্যাহারা সংসার ত্যাগ করিয়া অরণ্য আশ্রয় গ্রহণ করেন, যাহাদের নিকট ভালমন্দ স্বন্দর কুৎসিত অস্তর বাহিরের ভেদ একেবারে ঘুচিয়া গেছে ব্ৰহ্মজ্ঞান ব্রস্কোপাসনা তাহাদেরই জন্ত ? তাই যদি হইবে তবে ব্রহ্মবাদী ঋষি ব্রহ্মচারী ব্রহ্মজিজ্ঞাস্ব শিষ্যকে কেন আমুশাসন করিতেছেন প্রজাতন্তুং মা ব্যবচ্ছেংসীঃ, সন্তানস্থত্র ছেদন করিবে না, অর্থাৎ গৃহাশ্রমে প্রবেশ করিবে । কেন শাস্ত্রকার বিশেষ করিয়া উপদেশ দিতেছেন, ব্রহ্মনিষ্ঠে গৃহস্থঃ স্থাৎ, গৃহস্থ ব্যক্তি ব্রহ্মনিষ্ঠ হইবেন ; এবং তত্ত্বজ্ঞান পরায়ণ, তত্ত্বজ্ঞানী হইবেন, অর্থাৎ যে নিষ্ঠার কথা কহিলেন তাহা যেন অজ্ঞান-নিষ্ঠা না হয়, গৃহী যথার্থ জ্ঞানপূর্বক ব্রহ্মে নিরত হইবেন, এবং যদষদ কৰ্ম্ম প্রকুৰ্ব্বতি তত্ত্ব হ্মণি সমৰ্পয়েং যে যে কৰ্ম্ম করিবেন তাহ ব্রহ্মে সমর্পণ করিবেন — অতএব শাস্ত্রের অনুশাসন এই যে, গৃহী ব্যক্তিকে কেবল ভক্তিতে নহে, জ্ঞানে, কেবল জ্ঞানে নহে, কৰ্ম্মে, হৃদয়ে মনে এবং চেষ্টায় সৰ্ব্বতোভাবে ব্রহ্মপরায়ণ হইতে হইবে। অতএব সংসারের মধ্যে থাকিয়া আমরা সৰ্ব্বদা সৰ্ব্বত্র ব্রহ্মের সত্তা উপলব্ধি করিব, অন্তরাত্মার মধ্যে তাহার অধিষ্ঠান অনুভব করিব এবং আমাদের সমুদয় কৰ্ম্ম তাহার সম্মুখে কৃত এবং তাহার উদ্দেশে সমৰ্পিত হইবে । কিন্তু সৰ্ব্বদা সৰ্ব্বত্র তাহার সত্তা উপলব্ধি করিতে হইলে, চতুর্দিকের জড়বস্তুরাশিকে অপসারিত করিয়া ব্রহ্মের মধ্যেই আপনাকে সম্পূর্ণ আশ্রিত আবৃত নিমগ্ন অনুভব করিতে হইলে তাহাকে সাকাররূপে কল্পনাই করা যায় না। উপনিষদে আছে, যদিদং কিঞ্চ জগৎ সৰ্ব্বং প্রাণ এজতি নিঃস্থতং–এই সমস্ত জগৎ সেই প্রাণ হইতে নিঃস্থত হইয়া সেই প্রাণের মধ্যে কম্পিত হইতেছে। অনন্ত প্রাণের মধ্যে সমস্ত বিশ্বচরাচর অহৰ্নিশি স্পদমান রহিয়াছে এই ভাব কি আমরা কোন প্রকার হস্তপদবিশিষ্ট মূৰ্ত্তি-দ্বারা কল্পনা করিতে পারি ? অথচ যদিদং কিঞ্চ জগৎ সৰ্ব্বং প্রাণ এজতি, এই যাহা কিছু জগৎ সমস্ত প্রাণের মধ্যে কম্পিত হইতেছে এ কথা মনে উদয় হইবামাত্র তৎক্ষণাৎ তৃণগুম্মলতাপুষ্পপল্লব পশুপক্ষী মকুন্য চন্দ্রস্থৰ্য্যগ্রহনক্ষত্র, জগতের প্রত্যেক কম্পমান অণু পরমাণু এক মহাপ্রাণের ঐক্যসমুদ্রে হিল্লোলিত দেখিতে পাই—এক মহাপ্রাণের অনন্তকম্পিত বীণাতন্ত্রী হইতে এই বিপুল বিচিত্র বিশ্ব-সঙ্গীত ঝঙ্কত শুনিতে পাই। অনস্তপ্রাণের সেই অনির্দেশু্যতা অনিৰ্ব্বচনীয়তাই আমাদের চিত্তকে প্রসারিত করিয়া দেয় । সেই জগদ্ব্যাপী জগদতীত প্রাণকে কোন নির্দিষ্ট সঙ্কীর্ণ আকারের মধ্যে কল্পনা করিতে গেলে তখন আর তাহাকে আমাদের নিঃশ্বাসের মধ্যে পাই না, আমাদের চক্ষের নিমেষের মধ্যে পাই না, আমাদের রক্তের উত্তপ্ত প্রবাহ, আমাদের সর্বাঙ্গের