পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অচলিত) দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আলোচনা ՀG মূল ধৰ্ম্ম। একজন বলিতেছেন, যখন প্রকৃতির মধ্যে সৰ্ব্বত্রই নৃশংসতা দেখিতেছি, তখন নিষ্ঠুরতা যে জগতের ধৰ্ম্ম নহে, এ কে বলিতেছে ? জগতের অস্তিত্বই স্বয়ং বলিতেছে। নিষ্ঠুরতাই যদি জগতের মূলগত নিয়ম হইত, হিংসাই যদি জগতের আশ্রয়স্থল হইত, তবে জগৎ এক মুহূৰ্ত্ত বাচিত না। উপর হইতে যাহা দেখি তাহ ধৰ্ম্ম নহে। উপর হইতে আমরা ত চতুর্দিকে পরিবর্তন দেখিতেছি, কিন্তু জগতের মূল ধৰ্ম্ম কি অপরিবৰ্ত্তনীয়তা নহে? আমরা চারিদিকেই ত অনৈক্য দেখিতেছি, কিন্তু তাহার মূলে কি ঐক্য বিরাজ করিতেছে না ? তাহা যদি না করিত, তাহা হইলে এ জগৎ বিশৃঙ্খলার নরকরাজ্য হইত, সৌন্দর্ঘ্যের স্বৰ্গরাজ্য হইত না । তাহা হইলে কিছু হইতেই পারিত না, কিছু থাকিতেই পারিত না । একটি রূপক। অনেক লোক আছেন, তাহারা জগতের সর্বত্রই অমঙ্গল দেখেন। র্তাহাদের মুখে জগতের অবস্থা যেরূপ শুনা যায়, তাহাতে তাহার আর এক মূহূৰ্ত্ত টিকিয়া থাকিবার কথা নহে। সৰ্ব্বত্রই যে শোক তাপ দুঃখ-যন্ত্রণা দেখিতেছি এ কথা অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু তবুও ত জগতের সঙ্গীত থামে নাই ! তাহার কারণ, জগতের প্রাণের মধ্যে গভীর আনন্দ বিরাজ করিতেছে। সে আনন্দ-আলোক কিছুতেই আচ্ছন্ন করিতে পারিতেছে না, বরঞ্চ যত কিছু শোক তাপ সেই দীপ্ত আনন্দে বিলীন হইয়া যাইতেছে। শিবের সহিত জগতের তুলনা হয়। অসীম অন্ধকার-দিক-বসন পরিয়া ভূতনাথ-পশুপতি জগৎ কোটি কোটি ভূত লইয়া অনন্ত তাগুবে উন্মত্ত। কণ্ঠের মধ্যে বিষ পূর্ণ রহিয়াছে, তবু নৃত্য। বিষধর সর্প তাহার অঙ্গের ভূষণ হইয়া রহিয়াছে, তবু মৃত্য। মরণের রঙ্গভূমি শ্মশানের মধ্যে র্তাহার বাস, তবু নৃত্য। মৃত্যুস্বরূপিনী কালী র্তাহার বক্ষের উপরে সর্বদা বিচরণ করিতেছেন, তবু তাহার আনন্দের বিরাম নাই। যাহার প্রাণের মধ্যে অমৃত ও আনন্দের অনন্ত প্রস্রবণ, এত হলাহল এত অমঙ্গল তিনিই যদি ধারণ করিতে না পারিবেন তবে আর কে পারিবে ! সপের ফণা, হলাহলের নীলছ্যুতি বাহির হইতে দেখিয়া আমরা শিবকে দুঃখী মনে করিতেছি, কিন্তু তাহার জটাজালের মধ্যে প্রচ্ছন্ন চির-স্রোত অমৃত-নিস্তন্দিনী পুণ্য ভাগীরথীর আনন্দ-কল্লোল কি শুনা যাইতেছে না ? নিজের ডমরুধ্বনিতে, নিজের অস্ফুট হর্ষগানে উন্মত্ত হইয়া নিজে যে অবিশ্রাম নৃত্য করিতেছেন, তাহার গভীর কারণ কি দেখিতে পাইতেছি ?