পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অচলিত) দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

• রবীন্দ্র-রচনাবলী কিছু পাইয়াছেন, অতীতের কাছ হইতে তাহা অপেক্ষ অনেক বেশী পাইয়াছেন, তবে কেন অতীতের প্রতি ইহাদের এমনতর অকৃতজ্ঞ অবহেলা ! অতীতের অনাবশ্বক যাহা কিছু, তাহ সমস্তই ইহার কেন কুসংস্কার বলিয়া একেবারে ঝাটাইয়া ফেলিতে চান ? তাহারা ইহা বুঝেন না, শুষ্ক জ্ঞানের চক্ষে সমস্ত আবশ্বক অনাবশ্বক ধরা পড়ে না । আমাদের আচার ব্যবহারে কতকগুলি চিরন্তন প্রথা প্রচলিত আছে, সেগুলি ভালও নয়, মন্দও নয়, কেবল দোষের মধ্যে তাহারা অনাবশ্বক, তাহাদের দেখিয়া কঠোর জ্ঞানবান লোকের মুখে হাসি আসে, এই ছুতায় তুমি তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিলে। মনে করিলে, তুমি কতকগুলি অর্থহীন অনাবশ্বক হাস্যরসোদ্দীপক অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করিলে মাত্র—কিন্তু আসলে কি করিলে ! সেই অর্থহীন প্রথার মন্দিরমধ্যে অধিষ্ঠিত স্থমহং অতীত দেবকে ভাঙ্গিয়া ফেলিলে, একটি জীবন্ত ইতিহাসকে বধ করিলে, তোমার পূর্বপুরুষদিগের একটি স্মরণ-চিহ্ন ধ্বংস করিয়া ফেলিলে। তোমার কাছে তোমার মায়ের যদি একটি স্মরণ-চিহ্ন থাকে, বাজারে তাহার দাম নাই বলিয়া তোমার কাছেও যদি তাহার দাম না থাকে তবে তুমি মহাপাতকী। তেমনি অনেকগুলি অর্থহীন প্রথা পূৰ্ব্বপুরুষদিগের ইতিহাস বলিয়াই মূল্যবান। তুমি যদি তাহার মূল্য না দেখিতে পাও, তাহ অকাতরে ফেলিয়া দাও, তবে তোমার শরীরে দয়া-ধৰ্ম্ম কোনখানে থাকে তাহাই আমি ভাবি ! যাহাদের বুট-তরি আশ্রয় করিয়া তোমরা ভবসমুদ্র পার হইতে চাও, সেই ইংরাজ মহাপুরুষেরা কি করেন একবার দেখ না। র্তাহাদের রাজসভায়, তাহাদের পার্ল্যামেণ্ট সমিতিতে, এবং অন্যান্য নানা স্থলে কতশত প্রকার অর্থহীন অনুষ্ঠান প্রচলিত আছে, তাহা কে না জানে! অতীত কাল ধরণীর মত আমাদের অচলপ্রতিষ্ঠ করিয়া রাখে। যখন বাহিরে রৌদ্রের খরতর তাপ, আকাশ হইতে বৃষ্টি পড়ে না, তখন শিকড়ের প্রভাবে আমরা অতীতের অন্ধকার নিম্নতন দেশ হইতে রস আকর্ষণ করিতে পারি। যখন সকল স্থখ ফুরাইয়া গেছে তখন আমরা পিছন ফিরিয়া অতীতের ভগ্নাবশিষ্ট চিহ্নসকল অমুসরণ করিয়া অতীতে যাইবার পথ অনুসন্ধান করিয়া লই । বর্তমানে যখন নিতান্ত দুর্ভিক্ষ নিতান্ত উৎপীড়ন দেখি তখন অতীতের মাতৃক্রোড়ে বিশ্রাম করিতে যাই । বাঙ্গালা সাহিত্যে যে এত পুরাতত্বের আলোচনা দেখা যাইতেছে, তাহার প্রধান কারণ আমাদের একমাত্র সানার স্থল অতীত কালকে জীবস্ত করিয়া তুলিবার চেষ্টা হইতেছে। সে পথও যদি কেহ বন্ধ করিতে চায়, অতীতের যাহা কিছু অবশেষ আমাদের ঘরে ঘরে পড়িয়া রহিয়াছে তাহাকে দূর করিয়া যদি কেহ অতীতকে আরও অতীতে ফেলিতে চায়, তবে সে সমস্ত জাতির অভিশাপের পাত্র হইবে।