পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অচলিত) দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমালোচনা ‘A& লোকে সাধারণতঃ বুঝিয়া থাকে, একটা মারামারি কাটাকাটির ব্যাপার! যাহাতে যুদ্ধ নাই, তাহা আর এপিক্‌ হইবে কি করিয়া ? আমরা যতগুলি বিখ্যাত এপিক দেখিয়াছি তাহার প্রায় সবগুলিতেই যুদ্ধ আছে সত্য, কিন্তু তাহাই বলিয়া এমন প্রতিজ্ঞ করিয়া বস ভাল হয় না, যে, যুদ্ধ ছাড়িয়া দিয়া যদি কেহ এপিক্‌ লেখে, তবে তাহাকে এপিক্‌ বলিব না ! এপিক্‌ কাব্য লেখার আরম্ভ হইল কি হইতে ? কবির এপিক্‌ লেখেন কেন ? এখনকার কবিরা যেমন "এস, একটা এপিক্‌ লেখা যাকৃ” বলিয়া সরস্বতীর সহিত বন্দোবস্ত করিয়া এপিকু লিথিতে বসেন, প্রাচীন কবিদের মধ্যে অবশ্য সে ফেসিয়ান ছিল না । মনের মধ্যে যখন একটা বেগবান অস্থভাবের উদয় হয়, তখন কবিরা তাহা গীতিকাব্যে প্রকাশ না করিয়া থাকিতে পারেন না ; তেমনি মনের মধ্যে যখন একটি মহৎ ব্যক্তির উদয় হয়, সহসা যখন এক জন পরমপুরুষ কবিদের কল্পনার রাজ্য অধিকার করিয়া বসেন, মনুষ্য-চরিত্রের উদার-মহত্ত্ব র্তাহাদের মনশ্চক্ষের সম্মুখে অধিষ্ঠিত হয়, তখন তাহারা উন্নতভাবে উদ্দীপ্ত হইয়া সেই পরমপুরুষের প্রতিম প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য ভাষার মন্দির নির্মাণ করিতে থাকেন ; সে মন্দিরের ভিত্তি পৃথিবীর গভীর অস্তর্দেশে নিবিষ্ট থাকে, সে মন্দিরের চূড়া আকাশের মেঘ ভেদ করিয়া উঠে। সেই মন্দিরের মধ্যে যে প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত হন, তাহার দেবভাবে মুগ্ধ হইয়া, পুণ্য-কিরণে অভিভূত হইয়া নানা দিগদেশ হইতে যাত্রীরা তাহাকে প্রণাম করিতে আসে । ইহাকেই বলে মহাকাব্য ! মহাকাব্য পড়িয়া আমরা তাহার রচনাকালের যথার্থ উন্নতি অনুমান করিয়া লইতে পারি। আমরা বুঝিতে পারি সেই সময়কার উচ্চতম আদর্শ কি ছিল । কাহাকে তখনকার লোকেরা মহত্ত্ব বলিত । আমরা দেখিতেছি, হোমরের সময়ে শারীরিক বলকেই বীরত্ব বলিত, শারীরিক বলের নামই ছিল মহত্ব। বাহুবলদৃপ্ত একিলিসই ইলিয়ডের নায়ক ও যুদ্ধবর্ণনাই তাহার আদ্যোপাস্ত । আর আমরা দেখিতেছি, বাল্মীকির সময়ে ধৰ্ম্মবলই যথার্থ মহত্ত্ব বলিয়া গণ্য ছিল—কেবল মাত্র দাম্ভিক বাহুবলকে তখন ঘৃণা করিত। হোমরে দেখ, একিলিসের ঔদ্ধত্য, একিলিসের বাহুবল, একিলিসের হিংস্রপ্রবৃত্তি ; আর রামায়ণে দেখ, এক দিকে রামের, সত্যের অনুরোধে আত্মত্যাগ, এক দিকে লক্ষ্মণের, প্রেমের অনুরোধে আত্মত্যাগ, এক দিকে বিভীষণের, ন্যায়ের অনুরোধে সংসার ত্যাগ । রামও যুদ্ধ করিয়াছেন, কিন্তু সেই যুদ্ধ ঘটনাই তাহার সমস্ত চরিত্র ব্যাপ্ত করিয়া থাকে নাই, তাহা তাহার চরিত্রের সামান্ত এক অংশ মাত্র। ইহা হইতে প্রমাণ হইতেছে, হোমরের সময়ে বলকেই ধৰ্ম্ম বলিয়া জানিত ও বাল্মীকির সময়ে ধৰ্ম্মকেই বল বলিয়া