পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে । ১৬৫ অন্যায়কে কর্তব্য, অধর্মকে পুণ্য ব’লে চালাতে চাও তখন আমার হৃদয়ে লাগে বলেই আমি স্থির থাকতে পারি নে। আমি যদি নিজের স্বার্থসাধনের জন্তে চুরি করি, তাহলে নিজের প্রতি আমার যে সত্য প্রেম তারই কি মূলে ঘা দিই নে ? চুরি করতে পারি নে যে, সে কি বুদ্ধি আছে বলে ? না, নিজের প্রতি শ্রদ্ধা আছে বলে ? ভিতরে ভিতরে আমার রাগ হচ্ছিল আমি আর থাকতে পারলুম না। আমি বলে উঠলুম, ইংরেজ ফরাসি জৰ্মান রুশ এমন কোন সভ্যদেশ আছে যার ইতিহাস নিজের দেশের জন্তে চুরির ইতিহাস নয় ? সে-চুরির জবাবদিহি তাদের করতে হবে, এখনো করতে হচ্ছে । ইতিহাস এখনো শেষ হয়ে যায় নি । সন্দীপবাবু বললেন, বেশ তে। আমরাও তাই করব । চোরাই মালে আগে ঘরটা বোঝাই করে তার পরে ধীরে মুস্থে দীর্ঘকাল ধরে আমরাও জবাবদিহি করব । কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, তুমি যে বললে এখনো তারা জবাবদিহি করছে সেটা কোথায় ? রোম যখন নিজের পাপের জবাবদিহি করছিল তখন তা কেউ দেখতে পায় নি । তখন তার ঐশ্বর্ষের সীমা ছিল না। বড়ো বড়ো ডাকাত-সভ্যতারও জবাৰদিহির দিন কখন আসে তা বাইরে থেকে দেখা যায় না। কিন্তু একটা জিনিস কি দেখতে পাচ্ছ না—ওদের পলিটিক্সের ঝুলিওরা মিথ্যাকথা, প্রবঞ্চনা, বিশ্বাসঘাতকতা, গুপ্তচরবৃত্তি, প্রেষ্টিজরক্ষার লোভে দ্যায় ও সত্যকে বলিদান, এই যে সব পাপের বোঝা নিয়ে চলেছে এর ভার কি কম ? আর এ কি প্রতিদিন ওদের সভ্যতার বুকের রক্ত শুষে খাচ্ছে না ? দেশের উপরেও যারা ধর্মকে মানছে না, আমি বলছি তারা, দেশকেও মানছে না । আমার স্বামীকে আমি কোনোদিন বাইরের লোকের সঙ্গে তর্ক করতে শুনি নি— আমার সঙ্গে তিনি তর্ক করেছেন কিন্তু আমার প্রতি তার এমন গভীর করুণা যে, আমাকে হার মানাতে র্তার কষ্ট হত । আজ দেখলুম তার অস্ত্রচালনা। আমার স্বামীর কথাগুলোতে কোনোমতেই আমার মন সায় দিচ্ছিল না । কেবলই মনে হচ্ছিল, এর উপযুক্ত উত্তর আছে, উপস্থিতমত লে আমার মনে জোগাচ্ছিল না। মুশকিল এই যে, ধর্মের দোহাই দিলে চুপ করে যেতে হয়—এ-কথা বলা শক্ত ধর্মকে অতটা দূর পর্বত্ত মানতে রাজি নই। এই তর্ক সম্বন্ধে ভালোরকম জবাব দিয়ে আমি একটা লিখব এবং সেটা সন্দ্বীপবাবুর হাতে দেব আমার মনে এই সংকল্প ছিল। তাই আজকের কথাবার্তাগুলো ঘরে ফিরে এসেই আমি নোট করে নিয়েছি।