পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sషా8 রবীন্দ্র-রচনাবলী এক-একদিন মনে হত সে আমাকে রেগে যেন ছিড়ে ফেলে দেবে। সেদিনকার কথা আমার বেশ মনে আছে যেদিন সে চীৎকার করে যাও যাও বলে আমাকে ঘর থেকে জোর করে তাড়িয়ে দিলে—তার পরে যেমনি আমি চৌকাঠের বাইরে পা বাড়িয়েছি অমনি সে ছুটে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে কঁদিতে কঁদিতে মেঝেতে মাথা ঠুকতে ঠুকতে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল। ওদের আমি খুব জানি–রাগ বল, ভয় বল, লজ্জা বল, স্বণ বল এ-সমস্তই জালানি কাঠের মতো ওদের হৃদয়ের আগুনকে বাড়িয়ে তুলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যে-জিনিস এ আগুনকে সামলাতে পারে সে হচ্ছে আইডিয়াল । মেয়েদের সে-বালাই নেই। ওরা পুণ্যি করে, তীর্থ করে, গুরুঠাকুরের পায়ের কাছে গড় হয়ে পড়ে প্রণাম করে—আমরা যেমন করে আপিস করি—কিন্তু আইডিয়ার ধার দিয়ে যায় না । আমি নিজের মুখে ওকে বেশি কিছু বলব না—এখনকার কালের কতকগুলো ইংরেজি বই ওকে পড়তে দেব । ও ক্রমে ক্রমে বেশ স্পষ্ট করে বুঝতে পারুক যে প্রবৃত্তিকে বাস্তব বলে স্বীকার করা ও শ্রদ্ধা করাই হচ্ছে মডারন । প্রবৃত্তিকে লজ্জা করা, সংযমকে বড়ো জানাট মডারন নয়। "মডারন” এই কথাটার যদি আশ্রয় পায় তাহলেই ও জোর পাবে—কেননা ওদের তীর্থ চাই, গুরুঠাকুর চাই, বাধা সংস্কার চাই—শুধু আইডিয়া ওদের কাছে ফাকা । যাই হ’ক, এ নাট্যটা পঞ্চম অঙ্ক পর্যন্ত দেখা যাক । এ-কথা জাক করে বলতে পারব না আমি কেবলমাত্র দর্শক, উপরের তলায় রয়াল সৗটে বসে মাঝে মাঝে কেবল হাততালি দিচ্ছি। বুকের ভিতরে টান পড়ছে, থেকে থেকে শিরগুলো ব্যথিয়ে উঠছে। রাত্রে বাতি নিবিয়ে বিছানায় যখন শুই তখন এতটুকু ছোওয়া, এতটুকু চাওয়া, এতটুকু কথা অন্ধকার ভর্তি করে কেবলই ঘুরে ঘুরে বেড়ায় । সকালে ঘুম থেকে উঠে মনের ভিতরটায় একটা পুলক ঝিলমিল করতে থাকে,– মনে হয় যেন রক্তের সঙ্গে সঙ্গে সর্বাঙ্গে একটা সুরের ধারা বইছে । এই টেবিলের উপরকার ফোটো-স্ট্যাণ্ডে নিখিলের ছবির পাশে মক্ষীর ছবি ছিল । আমি সে-ছবিটি খুলে নিয়েছিলুম। কাল মক্ষীকে সেই ফাকটা দেখিয়ে বললুম, কৃপণের কৃপণতার দোষেই চুরি হয়, অতএব এই চুরির পাপটা কৃপণে চোরে ভাগাভাগি করে নেওয়াই উচিত। কী বলেন ? মক্ষী একটু হাসলে, বললে, ও ছবিটা তো তেমন ভালো ছিল না । আমি বললুম, কী করা যাবে ? ছবি তো কোনোমতেই ছবির চেয়ে ভালো হয় না। ও যা তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকব ।