পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

& е е রবীন্দ্র-রচনাবলী মাত্র—এক ক্ষুধিত বস্তায় মাঝখানের সমস্ত বাধা ডিঙিয়ে, যেখানে খিড়কির ঘাটে আমি বাসন মাজি, জল তুলি, সেইখানে আমার পায়ের কাছে ফেনা এলিয়ে দিয়ে তার অসীমতা নিয়ে সে লুটিয়ে পড়ল । আমি গোড়ায় সন্দীপবাবুকে ভক্তি করতে আরম্ভ করেছিলুম, কিন্তু সে-ভক্তি গেল ভেসে—তাকে শ্রদ্ধাও করি নে, এমন কি, তাকে অশ্রদ্ধাই করি। আমি খুব স্পষ্ট করেই বুঝেছি আমার স্বামীর সঙ্গে তার তুলনাই হয় না। এও আমি, প্রথমে না হ’ক ক্রমে ক্রমে জানতে পেরেছি যে, সন্দীপের মধ্যে যে-জিনিসটাকে পৌরুষ বলে ভ্রম হয়, সেটা চাঞ্চল্য মাত্র । তবু আমার এই রক্তে-মাংসে এই ভাবে-ভাবনায় গড়া বীণাট। ওঁরই হাতে বাজতে লাগল। সেই হাতটাকে আমি ঘৃণা করতে চাই এবং এই বীণাটাকে,–কিন্তু বীণা তো বাজল । আর সেই স্বরে যখন আমার দিনরাত্রি ভরে উঠল তখন আমার আর দয়ামায় রইল না। এই মুরের রসাতলে তুমিও মজো, আর তোমার যা কিছু আছে সব মজিয়ে দাও এই কথা আমীর শিরার প্রত্যেক কম্পন আমার রক্তের প্রত্যেক ঢেউ আমাকে বলতে লগিল । এ-কথা আর বুঝতে বাকি নেই ষে আমার মধ্যে একটা কিছু আছে যেটা—কী বলব । যার জন্তে মনে হয় আমার মরে যাওয়াই ভালো । মাস্টারমশায় যখন একটু ফাক পান আমার কাছে এসে বসেন । তার একটা শক্তি আছে তিনি মনটাকে এমন একটা শিখরের উপর দাড় করিয়ে দিতে পারেন যেখান থেকে নিজের জীবনের পরিধিটাকে এক মুহুর্তে ই বড়ো করে দেখতে পাই— বরাবর যেটাকে সীমা বলে মনে করে এসেছি তখন দেখি সেটা সীমা নয় । কিন্তু কী হবে । আমি আমন করে দেখতেই চাই নে। যে-নেশায় আমাকে পেয়েছে সেই নেশাট ছেড়ে যাক এমন ইচ্ছাও যে আমি সত্য করে করতে পারি নে। ংসারের দুঃখ ঘটুক, আমার মধ্যে আমার সত্য পলে-পলে কালো হয়ে মরুক, কিন্তু আমার এই নেশ চিরকাল টিকে থাক এই ইচ্ছা যে কিছুতেই ছাড়াতে পারছি নে । আমার ননদ মুহুর স্বামী যখন মদ খেয়ে মুহুকে মারত, তারপরে মেরে অনুতাপে হাউ হাউ করে কাদত, শপথ করে বলত আর কখনও মদ ছোব না, আবার তার পরদিন সন্ধ্যাবেলাতেই মদ নিয়ে বসত—দেখে আমার সর্বাঙ্গ রাগে ঘৃণায় জলত । অাজকে দেখি আমার মদ খাওয়া যে তার চেয়ে ভয়ানক—এ মদ কিনে আনতে হয় না, গ্লাসে ঢালতে হয় না— রক্তের ভিতর থেকে আপনা-আপনি তৈরি হয়ে উঠছে । কী করি। এমনি করেই কি জীবন কাটবে ?