পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে პlo9% মাথা নিচু করে স্বপুরি কাটছেন,—মুখে একটু হাসি লেগে আছে, গুন গুন করে গান করছেন,“রাই আমার চলে যেতে ঢলে পড়ে,”—ইতিমধ্যে কোথাও যে কিছু অনৰ্থপাত হয়েছে তার কোনো লক্ষণ তার কোনোথানেই নেই। আমি বললুম, মেজোরানী তোমার থাকো ক্ষেমাকে এমন মিছিমিছি গাল দেয় কেন ? তিনি ভুরু তুলে আশ্চর্য হয়ে বললেন, ওম, সত্যি নাকি ? মাগীকে ঝাটাপেট করে দূর করে দেব। দেখো দেখি এই সকালবেলায় তোমার বৈঠকখানার আসর মাটি ক’রে দিলে। ক্ষেমারও আচ্ছা আক্কেল দেখছি, জানে তার মনিব বাইরের বাবুর সঙ্গে একটু গল্প করছে—একেবারে সেখানে গিয়ে উপস্থিত—লজ্জাশরমের মাথা থেয়ে বসেছে। তা ছোটোরানী, এ-সব ঘরকন্নার কথায় তুমি থেকে না, তুমি বাইরে যাও, আমি যেমন করে পারি সব মিটিয়ে দিচ্ছি। আশ্চর্য মাহুষের মন। এক মুহূর্তের মধ্যেই তার পালে এমন উলটে হাওয়া লাগে ! এষ্ট সকালবেলায় ঘরকল্প। ফেলে বাইরে সন্দীপের সঙ্গে বৈঠকখানায় আলাপ-আলোচনা করতে যাওয়া, আমার চিরকালের অস্তঃপুরের অভ্যস্ত আদর্শে এমনি স্বইছাড়া বলে মনে হল যে, আমি কোনো উত্তর না দিয়ে ঘরে চলে গেলুম। নিশ্চয় জানি ঠিক সময় বুঝে মেজোরানী নিজে থাকোকে টিপে দিয়ে ক্ষেমার সঙ্গে ঝগড়া করিয়েছেন । কিন্তু আমি এমনি টলমলে জায়গায় আছি যে এ-সব নিয়ে কোনো কথাই কইতে পারি নে। এই তো সেদিন ননকু দরোয়ানকে ছাড়িয়ে দেবার জন্যে প্রথম-ঝাজে আমার স্বামীর সঙ্গে যে-রকম উদ্ধতভাবে ঝগড়া করেছিলুম শেষ পর্যস্ত তা টিকল না । দেখতে দেখতে নিজের উত্তেজনাতেই নিজের মধ্যে একটা লজ্জা এল । এর মধ্যে আবার মেজোরানী এসে আমার স্বামীকে বললেন, ঠাকুরপো, আমারই অপরাধ। দেখে ভাই, আমরা সেকেলে লোক, তোমার ওই সন্দ্বীপবাবুর চালচলন কিছুতেই ভালো ঠেকে না—সেইজন্তে ভালো মনে করেই আমি দরোয়ানকে – তা এতে যে ছোটোরানীর অপমান হবে এ-কথা মনেও করি নি, বরঞ্চ ভেবেছিলুম উলটো । হায় রে পোড়া কপাল, আমার যেমন বুদ্ধি ! n এমনি করে দেশের দিক থেকে পূজার দিক থেকে ৰে-কথাটাকে এত উজ্জল করে দেখি সেইটেই যখন নিচের দিক থেকে এমন করে ঘুলিয়ে উঠতে থাকে তখন প্রথমটা হয় রাগ, তার পরেই মনে গ্লানি আসে । আজ শোবার ঘরে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে জানলার কাছে বসে বসে ভাবতে লাগলুম, চারদিকের সঙ্গে স্বর মিলিয়ে জীবনটা আসলে কতই সরল হতে পারে।