পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ミ>ペ রবীন্দ্র-রচনাবলী করি না কেন, আইডিয়ার উডুনির মধ্যে ফুটে আছে, ফাক আছে, তার ভিতর থেকে একটা জিনিস বেরিয়ে পড়ে সে নেহাত কাচা অতি নরম । তার কারণ, আমার অধিকাংশ আমার পূর্বেই তৈরি হয়ে গেছে। আমার চালাদের নিয়ে আমি মাঝে মাঝে নিষ্ঠুরের পরীক্ষা করি। একদিন বাগানে চড়িভাতি করতে গিয়েছিলুম। একটা ছাগল চরে বেড়াচ্ছিল, আমি সবাইকে বললুম, কে ওর পিছনের একখানা পা এই দা দিয়ে কেটে আনতে পারে ? সকলেই যখন ইতস্তত করছিল আমি নিজে গিয়ে কেটে নিয়ে এলুম। আমাদের দলের মধ্যে সকলের চেয়ে যে-লোক নিষ্ঠুর সে এই দৃশ্ব দেখে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেল । আমার শাস্ত অবিচলিত মুখ দেখে সকলেই নিবিকীর মহাপুরুষ বলে আমার পায়ের ধুলো নিলে। অর্থাৎ সেদিন সকলেই আমার আইডিয়ার বাষ্পমণ্ডলটাই দেখলে ; কিন্তু যেখানে আমি, নিজের দোষে না ভাগ্যদোষে, দুর্বল সকরুণ, যেখানে ভিতরে ভিতরে বুক ফাটছিল সেখানে আমাকে ঢাকা দেওয়াই ভালো । বিমল-নিখিলকে নিয়ে আমার জীবনের এই যে একটা অধ্যায় জমে উঠছে এর ভিতরেও অনেকটা কথা ঢাকা পড়ছে। ঢাকা পড়ত না যদি আমার মধ্যে আইডিয়ার কোনো বালাই না থাকত । আমার আইডিয়া আমার জীবনটাকে নিয়ে আপনার মতলবে গড়ছে কিন্তু সেই মতলবের বাইরেও অনেকখানি জীবন বাকি পড়ে থাকছে—সেইটের সঙ্গে আমার মতলবের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিল থাকে না—এই জন্তে তাকে চেপেচুপে ঢেকেঢুকে রাখতে চাই—নইলে সমস্তটাকে সে মাটি করে দেয় । প্রাণ-জিনিসটা অস্পষ্ট, সে যে কত বিরুদ্ধতার সমষ্টি তার ঠিক নেই। আমরা আইডিয়াওয়ালা মানুষ তাকে একটা বিশেষ ছাচে ঢেলে একটা কোনো বিশেষ আকারে সুস্পষ্ট করে জানতে চাই—সেই জীবনের সুস্পষ্টতাই জীবনের সফলতা । দিগবিজয়ী সেকেন্দর থেকে শুরু করে আজকের দিনের আমেরিকার ক্রোড়পতি রকফেলার পর্যন্ত সকলেই নিজেকে তলোয়ারের কিংবা টাকার বিশেষ একটা ছাচে ঢেলে জমিয়ে দেখতে পেরেছে বলেই নিজেকে সফল করে জেনেছে । এইখানেই আমাদের নিখিলের সঙ্গে আমার তর্ক বাধে । আমিও বলি আপনাকে জানো, সেও বলে আপনাকে জানো । কিন্তু সে যা বলে তাতে দাড়ায় এই আপনাকে না-জানাটাই হচ্ছে জানা । সে বলে, তুমি যাকে ফল-পাওয়া বল, সে হচ্ছে আপনাকে বাদ দিয়ে ফলটুকুকে পাওয়া। ফলের চেয়ে আত্মা বড়ো । আমি বললুম, কথাটা নেহাত ঝাপসা হল।