পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে २२S এমন সময় হঠাৎ পিছন থেকে বিমল ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে শেলফের দিকে যেতে যেতে বললুম, আমিয়েলস জর্নাল বইখানা নিতে এসেছি। এই কৈফিয়তটুকু দেবার কী যে দরকার ছিল তা তো জানি নে। কিন্তু এখানে আমি যেন অপরাধী, যেন অনধিকারী, যেন এমন কিছুর মধ্যে চোখ দিতে এসেছি যা লুকানো, যা লুকিয়ে থাকবারই যোগ্য । বিমলের মুখের দিকে আমি তাকাতে পারলুম না, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলুম। বাইরে আমার ঘরে বসে যখন বই পড়া অসম্ভব হয়ে উঠল, যখন জীবনের যা-কিছু সমস্তই যেন অসাধ্য হয়ে দাড়াল—কিছু দেখতে বা শুনতে, বলতে বা করতে লেশমাত্র আর প্রবৃত্তি রইল না, যখন আমার সমস্ত ভবিষ্যতের দিন সেই একটা মুহূর্তের মধ্যে জমাট হয়ে অচল হয়ে আমার বুকের উপর পাথরের মতো চেপে বসল ঠিক সেই সময়ে পঞ্চু একটা ঝুড়িতে গোটাকতক ঝুনো নারকেল নিয়ে আমার সামনে রেখে গড় হয়ে প্রণাম করলে । আমি জিজ্ঞাসা করলুম, এ কী পঞ্চ ? এ কেন ? পঞ্চু আমার প্রতিবেশী জমিদার হরিশ কুণ্ডুর প্রজা, মাস্টারমশায়ের যোগে তার সঙ্গে আমার পরিচয় । একে আমি তার জমিদার নই, তার উপরে সে গরিবের একশেষ—ওর কাছ থেকে কোনো উপহার গ্রহণ করবার অধিকার অামার নেই। মনে ভাবছিলুম বেচারা বোধ হয় আজ নিরুপায় হয়ে বকশিশের ছলে অল্পসংগ্রহের এই পন্থা করেছে । sä পকেটের টাকার থলি থেকে দুটো টাকা বের করে যখন ওকে দিতে যাচ্ছি তখন ও জোড়-হাত করে বললে, না হজুর, নিতে পারব না। সে কী পষ্ণু ? না, তবে খুলে বলি। বড়ো টানাটানির সময় একবার হজুরের সরকারি বাগান থেকে আমি নারকেল চুরি করেছিলুম। কোন দিন মরব তাই শোধ করে দিতে এসেছি । আমিয়েলস জর্নাল পড়ে আজ আমার কোনো ফল হত না—কিন্তু পঞ্চুর এই এককথায় আমার মন খোলসা হয়ে গেল। একজন স্ত্রীলোকের সঙ্গে মিলন-বিচ্ছেদের মখদুঃখ ছাড়িয়ে এ পৃথিবী অনেক দূর বিস্তৃত। বিপুল মানুষের জীবন ; তারই মাঝখানে দাড়িয়ে তবেই যেন নিজের হাসিকান্নার পরিমাপ করি । পধু আমার মাস্টারমশায়ের এক জন ভক্ত। কেমন করে এর সংসার চলে তা আমি জানি। রোজ ভোরে উঠে একটা চাঙারিতে করে পান দোক্তা রঙিন সুতো