পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ミ88 রবীন্দ্র-রচনাবলী বদল হবে। এই সমস্তই আমি খুব স্বচ্ছ করে দেখলুম, লেশমাত্র কুয়াশা কোথাও ছিল না । আমার সেই শোবার ঘরের ভাঙা খাচাটির ভিতর থেকে যখন সেই হেমস্ত মধ্যাহ্নের খোলা আলোর মধ্যে বেরিয়ে এলুম, তখন এক দল শালিখ আমার বাগানের গাছের তলায় অকস্মাৎ কী কারণে ভারি উত্তেজনার সঙ্গে কিচিমিচি বাধিয়েছে ; বারান্দার সামনে দক্ষিণে খোয়া-ফেলা রাস্তার দুই ধারে সারি সারি কাঞ্চন গাছ অজস্র গোলাপি ফুলের মুখরতায় আকাশকে অভিভূত করে দিয়েছে ; অদূরে মেঠো পথের প্রাস্তে শূন্ত গোরুর গাড়ি আকাশে পুচ্ছ তুলে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, তারই বন্ধনমুক্ত জোড়া গোরুর মধ্যে একটা ঘাস খাচ্ছে, আর-একট। রৌদ্রে শুয়ে পড়ে আছে, আর তার পিঠের উপর একটা কাক ঠোকর মেরে মেরে কীট উদ্ধার করছে—আরামে গোরুটার চোখ বুজে এসেছে। আজ আমার মনে হল, বিশ্বের এই ধা-কিছু খুব সহজ অথচ অত্যন্ত বৃহৎ আমি তারই স্পন্দিত বক্ষের খুব কাছে এসে বসেছি, তারই আতপ্ত নিশ্বাস ওই কাঞ্চন ফুলের গন্ধের সঙ্গে মিশে আমার হৃদয়ের উপরে এসে পড়ছে। আমার মনে হল, আমি আছি এবং সমস্তই আছে এই দুইয়ে মিলে আকাশ জুড়ে ষে-সংগীত বাজছে সে কী উদার, কী গভীর, কী অনির্বচনীয় স্বন্দর। তার পরে মনে পড়ল, দারিদ্র্য এবং চাতুরীর ফদে আটকা-পড়া পঞ্চু ; সেই পঞ্চুকে যেন দেখলুম আজ হেমস্তের রৌদ্রে বাংলার সমস্ত উদাস মাঠ-বাট জুড়ে ওই গোরুটার মতো চোখ বুজে পড়ে আছে—কিন্তু আরামে নয়, ক্লাস্তিতে, ব্যাধিতে, উপবাসে। সে যেন বাংলার সমস্ত গরিব রায়তের প্রতিমূর্তি। দেখতে পেলুম পরম আচারনিষ্ঠ ফোটাকাটা স্থূলতন্থ হরিশকুণ্ডু । সেও ছোটাে নয়, সেও বিরাট, সে যেন বাশবনের তলায় বহুকালের বদ্ধ পচা দিঘির উপর তেল সবুজ একটা অখণ্ড সরের মতো এপার থেকে ওপার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে ক্ষণে ক্ষণে বিষ-বুদবুদ উদ্‌গার করছে। যে প্রকাও তামসিকতা একদিকে উপবাসে কৃশ, অজ্ঞানে অন্ধ, অবসাদে জীর্ণ, আর-একদিকে মুমূৰুর রক্তশোষণে স্ফীত হয়ে আপনার অবিচলিত জড়ত্বের তলায় ধরিত্রীকে পীড়িত করে পড়ে আছে, শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে লড়াই করতে হবে,—এই কাজটা মুলতবি হয়ে পড়ে রয়েছে শত শত বৎসর ধরে। আমার মোহ ঘুচুক, আমার আবরণ কেটে যাক, আমার পৌরুষ অস্তঃপুরের স্বপ্নের জালে ব্যর্থ হয়ে জড়িয়ে পড়ে থাকে না যেন। আমরা পুরুষ, মুক্তিই আমাদের সাধনা, আইডিয়ালের ডাক গুনে আমরা সামনের দিকে ছুটে চলে যাব, দৈত্যপুরীর দেয়াল ডিঙিয়ে বন্দিনী লক্ষ্মীকে