পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२७8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ঘরে হাড়ি চড়ল না তখন স্ত্রীর রুপোর গয়না বেচতে বেরোল ; এই তার শেষ সম্বল । জমিদারের শাসনে গ্রামের কেউ তার গয়না কিনতেও সাহস করে না। জমিদারের নায়েব বললে, আমি কিনব, পাচ টাকা দামে। দাম তার টাক। ত্রিশ হবে। প্রাণের দায়ে পাচ টাকাতেই যখন সে রাজি হল তখন তার গয়নার পুটুলি নিয়ে নায়েব বললে, এই পাচ টাকা তোমার খাজনা বাকিতে জমা করে নিলুম। এই কথা শুনে আমরা সন্দীপবাবুকে বলেছিলুম, চক্রবর্তীকে আমরা বয়কট করব । সন্দীপবাবু, বললেন, এই সমস্ত জ্যান্ত লোককেই যদি বাদ দাও তাহলে কি ঘাটের মড়া নিয়ে দেশের কাজ করবে ? এরা প্রাণপণে ইচ্ছে করতে জানে ; এরাই তো প্রভু। যারা ষোলো আনা ইচ্ছে করতে জানে না, তারা, হয় এদের ইচ্ছেয় চলবে, নয় এদের ইচ্ছেয় মরবে। তিনি আপনার সঙ্গে তুলনা করে বললেন, আজ চক্রবর্তীর এলেকায় একটি মানুষ নেই যে স্বদেশী নিয়ে টু শব্দটি করতে পারে—অথচ নিখিলেশ হাজার ইচ্ছে করলেও স্বদেশী চালাতে পারবেন না । আমি বললুম, আমি স্বদেশীর চেয়ে বড়ো জিনিস চালাতে চাই, সেইজষ্ঠে স্বদেশী চালানো আমার পক্ষে শক্ত । আমি মরা খুটি চাই নে তো, আমি জ্যাস্ত গাছ চাই । আমার কাজে দেরি হবে। .* ঐতিহাসিক হেসে বললে, আপনি মরা খুটিও পাবেন না, জ্যাস্ত গাছও পারেন না। কেননা, সন্দীপবাবুর কথা আমি মানি—পাওয়া মানেই কেড়ে নেওয়া। এ-কথা শিখতে আমাদের সময় লেগেছে, কেননা, এগুলো ইস্কুলের শিক্ষার উলটো শিক্ষা । আমি নিজের চোখে দেখেছি, কুণ্ডুদের গোমস্ত গুরুচরণ ভাদুড়ি টাকা আদায় করতে বেরিয়েছিল—একটা মুসলমান প্রজার বেচে-কিনে নেবার মতো কিছু ছিল না। ছিল তার যুবতী স্ত্রী। ভাদুড়ি বললে, তোর বউকে নিকে দিয়ে টাকা শোধ করতে হবে। নিকে করবার উমেদার জুটে গেল, টাকাও শোধ হল। আপনাকে বলছি, স্বামীটার চোখের জল দেখে আমার রাত্রে ঘুম হয় নি, কিন্তু যতই কষ্ট হ’ক জামি এটা শিখেছি যে, যখন টাকা আদায় করতেই হবে তখন যে-মানুষ ঋণীর স্ত্রীকে বেচিয়ে টাকা সংগ্ৰহ করতে পারে, মানুষ-হিসেবে সে আমার চেয়ে বড়ো ;–আমি পারি নে, আমার চোখে জল আসে, তাই সব ফেসে যায়। আমার দেশকে কেউ যদি বাচায় তবে এই সব গোমস্তা, এই সব কুণ্ডু, এই সব চক্রবর্তীর । আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলুম, বললুম, তাই যদি হয়, তবে এই সব গোমস্তা, এই সব কুণ্ডু, এই সব চক্রবর্তীদের হাত থেকে দেশকে বাচাবার কাজই আমার। দেখো, দাসত্বের যে-বিষ মজার মধ্যে আছে সেইটেই যখন সুযোগ পেয়ে বাইরে ফুটে ওঠে