পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে 이 এ-টাকা লোহার সিন্দুকে ফেরবার পথ বন্ধ। আবার এই রাত্রে সেই ঘরে ফিরে গিয়ে সেই চাৰি নিয়ে সেই সিন্দুক খোলবার শক্তি আমার নেই। আমি তাহলে, স্বামীর ঘরের চৌকাঠের কাছে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব । এখন সামনে রাস্তা ছাড়া রাস্তাই নেই। কত টাকা নিলুম তাই যে বসে বসে গুনব, সে আমি লজ্জায় পারলুম না। ও যেমন ঢাকা আছে তেমনি ঢাকা থাক, চুরির হিসেব করব না । শীতের অন্ধকার রাত্রে আকাশে একটুও বাষ্প ছিল না ; সমস্ত তারাগুলি ঝকঝক করছে। আমি ছাদের উপর গুয়ে শুয়ে ভাবছিলুম—দেশের নাম করে ওই তারাগুলি যদি একটি একটি মোহরের মতো আমাকে চুরি করতে হত—অন্ধকারের বুকের মধ্যে সঞ্চিত ওই তারাগুলি—তার পরদিন থেকে চিরকালের জন্তে রাত্রি একেবারে বিধবা,—নিশীথের আকাশ একেবারে অন্ধ,—তাহলে সে-চুরি যে সমস্ত জগতের কাছ থেকে চুরি হত। আজ আমি এই যে চুরি করে আনলুম, এও তো টাকা চুরি নয়, এ ষে আকাশের চিরকালের আলো চুরিরই মতে—এ চুরি সমস্ত জগতের কাছ থেকে চুরি,—বিশ্বাস চুরি, ধর্ম চুরি । ছাদের উপর পড়ে রাত্রি কেটে গেল । সকালে যখন বুঝলুম আমার স্বামী এতক্ষণে উঠে চলে গেছেন তখন সর্বাঙ্গে শাল মুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে ঘরের দিকে চললুম। তখন মেজোরানী ঘটিতে করে তার বারান্দার টবের গাছকটিতে জল দিচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, ওলো ছোটোরানী, নেছিস খবর ? আমি চুপ করে দাড়ালুম, আমার বুকের মধ্যে র্কাপতে লাগল—মনে হতে লাগল, আঁচলে বাধা গিনিগুলো শালের ভিতর থেকে বড়ো বেশি উচু হয়ে আছে, মনে হল, এখনই আমার কাপড় ছিড়ে গিনিগুলো বারান্দাময় ঝনঝন করে ছড়িয়ে পড়বে,নিজের ঐশ্বর্য চুরি করে ফতুর হয়ে গেছে এমন চোর আজ এই বাড়ির দাসীচাকরদের কাছেও ধরা পড়ে যাবে । মেজোরানী বললেন, তোদের দেবীচৌধুরানীর দল ঠাকুরপোর তহবিল লুঠ করবে শাসিয়ে বেনামি চিঠি লিখেছে। আমি চোরের মতোই চুপ করে দাড়িয়ে রইলুম। আমি ঠাকুরপোকে বলছিলুম তোমার শরণাপন্ন হতে। দেবী প্রসন্ন হও গো, তোমার দলবল ঠেকাও । আমরা তোমার বন্দেমাতরমের শিল্পি মানছি। দেখতে দেখতে অনেক কাওই তো হল, এখন দোহাই তোমার, ঘরে সিদটা ঘটতে দিও না ।