পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে షాపివి কিন্তু আর দেরি ক’রে না। দেখে নিখিল, মানুষের ইতিহাস পৃথিবীর সমস্ত দেশকে সমস্ত জাতকে নিয়ে তৈরি হয়ে উঠেছে, এইজন্তে পলিটিক্সেও ধর্মকে বিকিয়ে দেশকে বাড়িয়ে তোলা চলবে না। অামি জানি যুরোপ এ-কথা মনের সঙ্গে মানে না কিন্তু তাই বলেই যে যুরোপই আমাদের গুরু এ আমি মানব না। সত্যের জন্তে মানুষ মরে অমর হয়, কোনো জাতিও যদি মরে, তাহলে মামুষের ইতিহাসে সেও অমর হবে। সেই সত্যের অনুভূতি জগতের মধ্যে এই ভারতবর্ষেই খাটি হয়ে উঠুক শয়তানের অভ্ৰভেদী অট্টহাসির মাঝখানে । কিন্তু বিদেশ থেকে এ কী পাপের মহামারী এসে আমাদের দেশে প্রবেশ করলে ? সমস্ত দিন এই সব নানা হাঙ্গামে কেটে গেল। শ্রান্ত হয়ে রাত্রে শুতে গেলুম। সেই টাকাটা আজ বের না করে কাল সকালে বের করে নেব স্থির করেছি। রাত্রে কখন একসময়ে ঘুম ভেঙে গেল । ঘর অন্ধকার । একটা কিসের শব্দ যেন শুনতে পাচ্ছি। বুঝি কেউ কঁদিছে । থেকে থেকে বাদল-রাতের দমকা হাওয়ার মতো চোখের জলে ভরা এক-একটা দীর্ঘনিশ্বাস শুনতে পাচ্ছি। আমার মনে হল, আমার এই ঘরটার বুকের ভিতরকার কাল্লা । আমার ঘরে আর-কেউ নেই। বিমলা কিছুদিন থেকে কোনো একটা পাশের ঘরে শোয়। আমি বিছানা থেকে উঠে পড়লুম। বাইরের বারান্দায় গিয়ে দেখি বিমলা মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। এ-সব কথা লিখতে পারা যায় না। এ যে কী, তা কেবল তিনিই জানেন যিনি বিশ্বের মর্মের মধ্যে বসে জগতের সমস্ত বেদনাকে গ্রহণ করছেন। আকাশ মূক, তারাগুলি নীরব, রাত্রি নিস্তব্ধ—তারই মাঝখানে ওই একটি নিজাহীন কাল্লা ! আমরা এই সব মুখদুঃখকে সংসারের সঙ্গে শাস্ত্রের সঙ্গে মিলিয়ে ভালোমন্দ একটা কিছু নাম দিয়ে চুকিয়ে ফেলে দিই। কিন্তু অন্ধকারের বক্ষ ভাসিয়ে দিয়ে এই যে ব্যথার উৎস উঠছে এর কি কোনো নাম আছে। সেই নিশীথরাত্রে সেই লক্ষকোটি তারার নিঃশঙ্কাতার মাঝখানে দাড়িয়ে আমি যখন ওর দিকে চেয়ে দেখলুম তখন আমার মন সভয়ে বলে উঠল, আমি একে বিচার করবার কে । হে প্রাণ, হে মৃত্যু, হে অসীম বিশ্ব, হে অসীম বিশ্বের ঈশ্বর, তোমাদের মধ্যে যে রহস্ত রয়েছে আমি জোড়হাতে তাকে প্রণাম করি।