পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

98 e ‘’ রবীন্দ্র-রচনাবলী অতএব দেখা যাইতেছে, বাহিরের জগতের সঙ্গে মানবের জগতের প্রভেদ আছে। কোনটা সাদা, কোনটা কালো, কোনটা বড়ো, কোনটা ছোটো, মানবের জগৎ সেই খবরটুকুমাত্র দেয় না। কোনটা প্রিয়, কোনটা অপ্রিয়, কোনটা স্বন্দর, কোনটা অম্বন্দর, কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, মামুষের জগৎ সেই কথাটা নানা স্বরে বলে । এই যে মানুষের জগৎ, ইহা আমাদের হৃদয়ে হৃদয়ে বহিয়া আসিতেছে। এই প্রবাহ পুরাতন এবং নিত্যনূতন। নব নব ইন্দ্রিয় নব নব হৃদয়ের ভিতর দিয়া এই সনাতন স্রোত চিরদিনই নবীভূত হইয়া চলিয়াছে। কিন্তু ইহাকে পাওয়া যায় কেমন করিয়া ? ইহাকে ধরিয়া রাখা যায় কী উপায়ে ? এই অপরূপ মানস-জগৎকে রূপ দিয়া পুনর্বার বাহিরে প্রকাশ করিতে না পারিলে ইহা চিরদিনই স্বই এবং চিরদিনই নষ্ট হইতে থাকে! কিন্তু এ-জিনিস নষ্ট হইতে চায় না। হৃদয়ের জগৎ আপনাকে ব্যক্ত করিবার জন্য ব্যাকুল । তাই চিরকালই মানুষের মধ্যে সাহিত্যের আবেগ । সাহিত্যের বিচার করিবার সময় দুইটা জিনিস দেখিতে হয় । প্রথম, বিশ্বের উপর সাহিত্যকারের হৃদয়ের অধিকার কতখানি—দ্বিতীয়, তাহা স্থায়ী আকারে ব্যক্ত হইয়াছে কতটা ? সকল সময় এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্ত থাকে না। যেখানে থাকে, সেখানেই সোনায় সোহাগা । কবির কল্পনাসচেতন হৃদয় যতই বিশ্বব্যাপী হয়, ততই তাহার রচনার গভীরতায় আমাদের পরিতৃপ্তি বাড়ে । ততই মানব-বিশ্বের সীমা বিস্তারিত হইয়া আমাদের চিরস্তন বিহারক্ষেত্র বিপুলতা লাভ করে। কিন্তু রচনাশক্তির নৈপুণ্যও সাহিত্যে মহামূল্য। কারণ, যাহাকে অবলম্বন করিয়া সে-শক্তি প্রকাশিত হয়, তাহা অপেক্ষাকৃত তুচ্ছ হইলেও এই শক্তিটি একেবারে নষ্ট হয় না । ইহা ভাষার মধ্যে সাহিত্যের মধ্যে সঞ্চিত হইতে থাকে । ইহাতে মানবের প্রকাশক্ষমতা বৃদ্ধি করিয়া দেয়। এই ক্ষমতাটি লাভের জন্ত মাছুষ চিরদিন ব্যাকুল । যে কৃতিগণের সাহায্যে মানুষের এই ক্ষমতা পরিপুষ্ট হইতে থাকে, মানুষ তাহাদিগকে যশস্বী করিয়া ঋণশোধের চেষ্টা করে । যে মানস-জগৎ হৃদয়ভাবের উপকরণে অস্তরের মধ্যে স্থষ্ট হইয়া উঠিতেছে, তাহাকে বাহিরে প্রকাশ করিবার উপায় কী ? க, তাহাকে এমন করিয়া প্রকাশ করিতে হইবে, যাহাতে হৃদয়ের ভাব উদ্রিক্ত হয়। হৃদয়ের ভাব উদ্রেক করিতে সাজসরঞ্জাম অনেক লাগে ।