পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V)88 রবীন্দ্র-রচনাবলী এই যে, প্রাণের অধিকার দেশ ও কালে, মনোভাবের অধিকার মনে এবং কালে । মনোভাবের চেষ্টা বহুকাল বরিয়া বহুমনকে আয়ত্ত করা। এই একান্ত আকাঙ্ক্ষায় কত প্রাচীন কাল ধরিয়া কত ইঙ্গিত, কত ভাষা, কত লিপি, কত পাথরে খোদাই, ধাতুতে ঢালাই, চামড়ায় বাধাই, কত গাছের ছালে, পাতায়, কাগজে, কত তুলিতে, খোস্তায়, কলমে, কত আঁকজোক, কত প্রয়াস—ব দিক হইতে ভাহিনে, ডাহিন দিক হইতে বায়ে, উপর হইতে নিচে, এক সার হইতে অন্ত সারে । কী ? না, আমি যাহা চিন্তা করিয়াছি, আমি যাহা অনুভব করিয়াছি, তাহা মরিবে না, তাহা মন হইতে মনে, কাল হইতে কালে চিস্তিত হইয়া, অনুভূত হইয়া, প্রবাহিত হইয়া চলিবে । আমার বাড়িঘর, অামার আসবাবপত্র, আমার শরীরমন, আমার মুখদুঃখের সামগ্রী, সমস্তই যাইবে—কেবল আমি যাহা ভাবিয়াছি, যাহা বোধ করিয়াছি, তাহা চিরদিন মানুষের ভাবনা, মানুষের বুদ্ধি আশ্রয় করিয়া সজীব সংসারের মাঝখানে বাচিয়া থাকিবে । মধ্য-এশিয়ায় গোবি-মরুভূমির বালুকাস্তুপের মধ্য হইতে যখন বিলুপ্ত মানবসমাজের বিস্মৃত প্রাচীনকালের জীর্ণ পুথি বাহির হইয়া পড়ে, তখন তাহার সেই অজানা ভাষার অপরিচিত অক্ষরগুলির মধ্যে কী একটি বেদনা প্রকাশ পায় ! কোন কালের কোন সজীব চিত্তের চেষ্টা আজ আমাদের মনের মধ্যে প্রবেশলাভের জন্ত অঁাকুবাকু করিতেছে। যে লিখিয়াছিল, সে নাই, যে লোকালয়ে লেখা হইয়াছিল, তাহাও নাই—কিন্তু মানুষের মনের ভাবটুকু মানুষের সুখদুঃখের মধ্যে লালিত হইবার জন্ত যুগ হইতে যুগান্তরে আসিয়া আপনার পরিচয় দিতে পারিতেছে না—দুই বাহু বাড়াইয়া মুখের দিকে চাহিতেছে। জগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক আপনার যে-কথাগুলিকে চিরকালের শ্রুতিগোচর করিতে চাহিয়াছিলেন, তাহাদিগকে তিনি পাহাড়ের গায়ে খুদিয়া দিয়াছিলেন। ভাবিয়াছিলেন, পাহাড় কোনোকালে মরিবে না, সরিবে না—অনস্তকালের পথের ধারে অচল হইয়া দাড়াইয়া নব নব যুগের পথিকদের কাছে এক কথা চিরদিন পরিয়া আবৃত্তি করিতে থাকিবে । পাহাড়কে তিনি কথা কহিবার ভার দিয়াছিলেন । পাহাড় কালাকালের কোনো বিচার না করিয়া তাহার ভাষা বহন করিয়া আসিয়াছে । কোথায় অশোক, কোথায় পাটলিপুত্র, কোথায় ধৰ্মজাগ্রত ভারতবর্ষের সেই গৌরবের দিন। কিন্তু পাহাড় সেদিনকার সেই কথা-কয়টি ৰুিন্ধত অক্ষরে অপ্রচলিত ভাষায় আজও উচ্চারণ করিতেছে। কতদিন অরণ্যে রোদন করিয়াছে,—