পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৫• রবীন্দ্র-রচনাবলী সত্যরক্ষাপূর্বক এই বড়ো করিয়া তুলিবার ক্ষমতায় সাহিত্যকারের যথার্থ পৰিচয় পাওয়া যায়। যেমনটি ঠিক তেমনি লিপিবদ্ধ করা সাহিত্য নহে । কারণ, প্রকৃতিতে যাহা দেখি, তাহা আমার কাছে প্রত্যক্ষ, আমার ইন্দ্রিয় তাহার সাক্ষ্য দেয়। সাহিত্যে যাহা দেখায়, তাহ প্রাকৃতিক হইলেও তাহ প্রত্যক্ষ নহে। স্বতরাং সাহিত্যে সেই প্রত্যক্ষভার অভাব পূরণ করিতে হয় । প্রাকৃতসত্যে এবং সাহিত্যসত্যে এইখানেই তফাত আরম্ভ হয় । সাহিত্যের মা যেমন করিয়া কাদে, প্রাকৃত মা তেমন করিয়া কাদে না । তাই বলিয়। সাহিত্যের মার কান্না মিথ্যা নহে। প্রথমত, প্রাকৃত রোদন এমন প্রত্যক্ষ যে, তাহার বেদনা আকারেইঙ্গিতে, কণ্ঠস্বরে, চারিদিকের দৃশ্বে এবং শোকঘটনার নিশ্চয় প্রমাণে আমাদের প্রতীতি ও সমবেদন উদ্রেক করিয়া দিতে বিলম্ব করে না । দ্বিতীয়ত, প্রাকৃত মা আপনার শোক সম্পূর্ণ ব্যক্ত করিতে পারে না, সে-ক্ষমতা তাহার নাই, সে-অবস্থাও তাহার নয় । এইজন্যই সাহিত্য ঠিক প্রকৃতির অরিশি নহে। কেবল সাহিত্য কেন, কোনো কলাবিদ্যাই প্রকৃতির যথাযথ অনুকরণ নহে। প্রকৃতিতে প্রত্যক্ষকে আমরা প্রতীতি করি, সাহিত্যে এবং ললিতকলায় অ প্রত্যক্ষ আমাদের কাছে প্রতীয়মান । অতএব এ-স্থলে একটি অপরটির আরশি হইয়া কোনো কাজ করিতে পারে না । এই প্রত্যক্ষতার অভাববশত সাহিত্যে ছন্দোবন্ধ-ভাষাভঙ্গির নানাপ্রকার কল-বল আশ্রয় করিতে হয় । এইরূপে রচনার বিষয়টি বাহিরে কৃত্রিম হইয়া অস্তরে প্রাকৃত অপেক্ষা অধিকতর সত্য হইয়া উঠে । এখানে “অধিকতর সত্য” এই কথাটা ব্যবহার করিবার বিশেষ তাৎপর্ব আছে। মামুষের ভাবসম্বন্ধে প্রাকৃত সত্য জড়িত-মিশ্রিত, ভগ্নখও, ক্ষণস্থায়ী। সংসারের ঢেউ ক্রমাগতই ওঠাপড়া করিতেছে—দেখিতে দেখিতে একটার ঘাড়ে আর-একটা আসিয়া পড়িতেছে—তাহার মধ্যে প্রধান-অপ্রধানের বিচার নাই—তুচ্ছ ও অসামান্ত গায়ে-গায়ে ঠেলাঠেলি করিয়া বেড়াইতেছে। প্রকৃতির এই বিরাট রঙ্গশালায় যখন মানুষের ভাবাভিনয় আমরা দেখি, তখন আমরা স্বভাবতই অনেক বাদসাদ দিয়া বাছিয়া লইয়া আন্দাজের দ্বারা অনেকট ভর্তি করিয়া কল্পনার দ্বারা অনেকটা গড়িয়া তুলিয়া থাকি । আমাদের একজন পরমাত্মীয়ও তfহার সমস্তটা লইয়া আমাদের কাছে পরিচিত নহেন। আমাদের স্মৃতি নিপুণ সাহিত্যরচয়িতার মতো তাহার অধিকাংশই বাদ দিয়া ফেলে। র্তাহার ছেটোবড়ো সমস্ত অংশই যদি ঠিক সমান অপক্ষপাতের সহিত আমাদের স্বতি অধিকার করিয়া থাকে, তবে এই স্তপের মধ্যে আসল চেহারাটি