পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૭૯ર রবীন্দ্র-রচনাবলী গেলে বিশেষভাবে স্বজনশক্তির আবশ্বক হয়। এইরূপে প্রকৃতি হইতে মনে ও মূল হইতে সাহিত্যে যাহা প্রতিফলিত হইয়া উঠে, তাহা অনুকরণ হইতে বহুদূরবতী । প্রকৃত সাহিত্যে আমরা আমাদের কল্পনাকে আমাদের সুখদুঃখকে, শুদ্ধ বর্তমান কাল নহে চিরস্তন কালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহি । সুতরাং সেই সুবিশাল প্রতিষ্ঠাক্ষেত্রের সহিত তাহার পরিমাণসামঞ্জস্ত করিতে হয়। ক্ষণকালের মধ্য হইতে উপকরণ সংগ্ৰহ করিয়া তাহাকে যখন চিরকালের জন্ত গড়িয়া তোলা যায়, তখন ক্ষণকালের মাপকাঠি লইয়া কাজ চলে না। এই কারণে প্রচলিত কালের সহিত, সংকীর্ণ সংসারের সহিত, উচ্চসাহিত্যের পরিমাণের প্রভেদ থাকিয়া যায় । অস্তরের জিনিসকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষার, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের এবং ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ । জগতের সহিত মনের যে সম্বন্ধ, মনের সহিত সাহিত্যকারের প্রতিভার সেই সম্বন্ধ । এই প্রতিভাকে বিশ্বমানবমন নাম দিলে ক্ষতি নাই। জগং হইতে মন আপনার জিনিস সংগ্ৰহ করিতেছে, সেই মন হইতে বিশ্বমানবমন পুনশ্চ নিজের জিনিস নির্বাচন করিয়া নিজের জন্ত গড়িয়া লইতেছে । বুঝিতেছি কথাটা বেশ ঝাপসা হইয়া আসিয়াছে । আর-একটু পরিস্ফুট করিতে চেষ্টা করিব । কৃতকার্য হইব কি না, জানি না। আমরা আমাদের অস্তরের মধ্যে দুইটা অংশের অস্তিত্ব অনুভব করিতে পারি। একটা অংশ আমার নিজত্ব, আর-একটা অংশ আমার মানবত্ব । আমার ঘরটা যদি সচেতন হইত, তবে সে নিজের ভিতরকার খণ্ডাকাশ ও তাহারই সহিত পরিব্যাপ্ত মহাকাশ, এই দুটাকে ধ্যানের দ্বার উপলব্ধি করিতে পারিত। আমাদের ভিতরকার নিজস্ব ও মানবত্ব সেইপ্রকার। যদি দুয়ের মধ্যে দুর্তেম্ভ দেয়াল তোলা থাকে তবে আত্মা অন্ধকূপের মধ্যে বাস করে। প্রকৃত সাহিত্যকারের অস্তঃকরণে যদি তাহার নিজস্ব ও মানবত্বের মধ্যে কোনো ব্যবধান থাকে, তবে তাহা কল্পনার কাচের শাসির স্বচ্ছ ব্যবধান । তাহার মধ্য দিয়া পরস্পরের চেনা-পরিচয়ের ব্যাঘাত ঘটে না। এমন কি, এই কাচ দূরবীক্ষণ ও অণুবীক্ষণের কাচের কাজ করিয়া থাকে-ইহা অদৃশুকে দৃশু, দূরকে নিকট করে। সাহিত্যকারের সেই মানবত্বই স্বজনকর্তা । লেখকের নিজকে সে আপনার করিয়া লয়, ক্ষণিককে সে অমর করিয়া তোলে, খণ্ডকে সে সম্পূর্ণতা দান করে। জগতের উপরে মনের কারখানা বসিয়াছে এবং মনের উপরে বিশ্বমনের কারখানা—সেই উপরের তলা হইতে সাহিত্যের উৎপত্তি ।