পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ஆ HIVෂ রবীন্দ্র-রচনাবলী কেবল দেশবিদেশের ছাপমার ডাকের টিকিট সংগ্ৰহ করিতেছে, সেজন্ত সন্ধানের এবং খরচের অন্ত নাই। এইরূপ সংগ্রহবায়ুদ্বারা খেপিয়া উঠিয়া কেহ বা চিনের বাসন, কেহ বা পুরাতন জুতা সংগ্ৰহ করিয়া মরিতেছে। উত্তর-মেরুর ঠিক কেন্দ্রস্থানটিতে গিয়া কোনোমতে একটা ধ্বজ পুতিয়া আসিতে হইবে, সে-ও এমনি একটা ব্যাপার। সেখানে বরফের ক্ষেত্র ছাড়া আর কিছু নাই, কিন্তু মন নিবৃত্ত হইতেছে না—কে সেই মেরুমরুর কেন্দ্রবিন্দুটির কত মাইল কাছে যাইতেছে, তাহারই অঙ্কপাতের নেশা পাইয়া বসিয়াছে। পাহাড়ে যে যত ফুট উচ্চে উঠিয়াছে, সে ততটাকেই একটা লাভ বলিয়া গণ্য করিতেছে ; এই শূন্ত লাভের জন্য নিজে মরিতেছে এবং কত অনিচ্ছুক মজুরদিগকে জোর করিয়া মারিতেছে, তবু থামিতে চাহিতেছে না । অপব্যয় এবং ক্লেশ যতই বেশি, প্রয়োজনহীন সঞ্চয় ও পরিণামহীন জয়লাভের গৌরবও তত বেশি বলিয়া বোধ হয়। নিয়মসাধনার লোভও ক্লেশের পরিমাণ খতাইয়া আনন্দভোগ করে। কঠিন শয্যায় শুইয়া যদি শুরু করা যায়, তবে মাটিতে বিছানা পাতিয়া, পরে একখানিমাত্র কম্বল বিছাইয়া, পরে কম্বল ছাড়িয়া শুধু মাটিতে শুইবার লোভ ক্রমেই বাড়িয়া উঠিতে থাকে। কৃচ্ছসাধনটাকেই লাভ মনে করিয়া শেষকালে আত্মঘাতে আসিয়া দাড়ি টানিতে হয়। ইহা আর-কিছু নয়, নিবৃত্তিকেই একটা প্রচণ্ড প্রবৃত্তি করিয়া তোলা, গলার ফাস ছিড়িবার চেষ্টাতেই গলায় ফাস অঁাটিয়া মরা। অতএব কেবলমাত্র নিয়মপালন করাটাকেই যদি লোভের জিনিস করিয়া তোলা যায়, তবে কঠোরতার চাপ কেবলই বাড়াইয়া তুলিয়া স্বভাব হইতে সৌন্দৰবোধকে একেবারে পিষিয়া বাহির করা যাইতে পারে, সন্দেহ নাই। কিন্তু পূর্ণতালাভের প্রতিই লক্ষ্য রাখিয়া সংযমচর্চাকেও যদি ঠিকমতো সংযত করিয়া রাখিতে পারি, তবে মহন্তত্বের কোনো উপাদানই আঘাত পায় না, বরঞ্চ পরিপুষ্ট হইয় উঠে। কথাটা এই যে, ভিতমাত্রই শক্ত হইয়া থাকে, না হইলে তাহা আশ্রয় দিতে পারে না। যাহা-কিছু ধারণ করিয়া থাকে, যাহা আকৃতিদান করে, তাহা কঠিন। মাছুষের শরীর যতই নরম হ’ক না কেন, যদি শক্ত হাড়ের উপরে তাহার পত্তন না হইত, তবে সে একটা পিও হইয়া থাকিত, তাহার চেহারা খুলিতই না। তেমনি জ্ঞানের ভিত্তিটাও শক্ত, আনন্দের ভিত্তিটাও শক্ত। জ্ঞানের ভিত্তি যদি শক্ত না হইত, তবে তো সে কেবল খাপছাড়া স্বপ্ন হইত, আর জানন্দের ভিত্তি যদি শক্ত না হইত, তবে তাহা নিতাস্তই পাগলামি মাতলামি হইয়া উঠিত।