পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৭৬ রবীন্দ্র-রচনাবলী করিয়া অনুভব করে—তfহাতেই তাহার গৌরব বাড়ে। বস্তুত ভালো করিয়া ভাবিয়া দেখিলে বিজ্ঞানদর্শন আর কিছুই নহে, বিষয়ের মধ্যে বুদ্ধির নিজেকেই উপলব্ধি । সে নিজের নিয়ম যেখানে দেখে, সেখানে সেই পদার্থকে এবং নিজেকে একত্র করিয়া দেখে। ইহাকেই বলে বুঝিতে পারা। এই দেখাতেই বুদ্ধির আনন্দ । নহিলে আপেলফল ষে-কারণে মাটিতে পড়ে, স্বর্য সেই কারণেই পৃথিবীকে টানে, এ-কথা বাহির করিয়া মানুষের এত খুশি হইবার কোনো কারণ ছিল না। টানে তো টানে, আমার তাহাতে কী ? আমার তাহাতে এই, জগৎচরাচরের এই ব্যাপক ব্যাপারকে আমার বুদ্ধির মধ্যে পাইলাম—সর্বত্রই আমার বুদ্ধিকে অনুভব করিলাম। আমার বুদ্ধির সঙ্গে ধূলি হইতে স্বৰ্ষচন্দ্রতার সবটা মিলিল। এমনি করিয়া অস্তহীন জগৎরহস্ত মানুষের বুদ্ধিকে বাহিরে টানিয়া আনিয়া মানুষের কাছে তাহাকে বেশি করিয়া প্রকাশ করিতেছে—নিখিলচরাচরের সঙ্গে মিলাইয়া আবার তাহা মানুষকে ফিরাইয়া দিতেছে । সমস্তের সঙ্গে এই বুদ্ধির মিলনই জ্ঞান । এই মিলনেই আমাদের বোধশক্তির আনন্দ । তেমনি সমস্ত মানুষের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে আপনার মহন্তত্বের মিলনকে পাওয়াই মানবাত্মার স্বাভাবিক ধর্ম এবং তাহাতেই তাহার যথার্থ আনন্দ । এই ধর্মকে পূর্ণচৈতনরূপে পাইবার জন্যই অস্তরে-বাহিরে কেবলই বিরোধ ও বাধার ভিতর দিয়াই তাহাকে চলিতে হয়। এইজগুই স্বার্থ এত প্রবল, আত্মাভিমান এত অটল, সংসারের পথ এত দুর্গম । এই সমস্ত বাধার ভিতর দিয়া যেখানে মানবের ধর্ম সমুজ্জল হইয়া পূর্ণমুনাররূপে সবলে নিজেকে প্রকাশ করে, সেখানে বড়ো আনন্দ । সেখানে আমরা আপনাকেই বড়ো করিয়া পাই। মহাপুরুষের জীবনী এইজন্যই আমরা পড়িতে চাই। তাহাদের চরিত্রে আমাদের নিজের বাধাযুক্ত আচ্ছন্ন প্রকৃতিকেই মুক্ত ও প্রসারিত দেখিতে পাই । ইতিহাসে আমরা আমাদেরই স্বভাবকে নানা লোকের মধ্যে নানা দেশে নানা কালে নানা ঘটনায় নানা পরিমাণে ও নানা আকারে দেখিয় রস পাইতে থাকি। তখন আমি স্পষ্ট করিয়া বুঝি বা না বুঝি, মনের মধ্যে স্বীকার করিতে থাকি সকল মানুষকে লইয়াই আমি এক—সেই ঐক্য যতটা-মাত্রায় আমি ঠিকমতো অনুভব করিব, ততটা-মাত্রায় আমার মঙ্গল আমার আনন্দ । o কিন্তু জীবনীতে ও ইতিহাসে আমরা সমস্তটা আগাগোড়া স্পষ্ট দেখিতে পাই না । তাহাও অনেক বাধায় অনেক সংশয়ে ঢাকা পড়িয়া অামাদের কাছে দেখা দেয় । তাহার মধ্য দিয়াও আমরা মানুষের যে-পরিচয় পাই, তাহা খুব বড়ো, সন্দেহ নাই ;