পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

86 е রবীক্স-রচনাবলী শেকস্পীয়রের অ্যান্টনি এবং ক্লিয়োপাট্রা নাটকের যে মূলব্যাপারটি তাহা সংসারের প্রাত্যহিক পরীক্ষিত ও পরিচিত সত্য। অনেক অখ্যাত অজ্ঞাত সুযোগ্য লোক কুহকিনী নারীমায়ার জালে আপন ইহকাল-পরকাল বিসর্জন করিয়াছে ; এইরূপ ছোটোখাটো মহত্ব ও মকুন্তত্বের শোচনীয় ভগ্নাবশেবে সংসারের পথ পরিকীর্ণ। আমাদের স্বপ্রত্যক্ষ নরনারীর বিষামৃতময় প্রণয়লীলাকে কবি একটি সুবিশাল ঐতিহাসিক রঙ্গভূমির মধ্যে স্থাপিত করিয়া তাহাকে বিরাট করিয়া তুলিয়াছেন। হৃদবিপ্লবের পশ্চাতে রাষ্ট্রবিপ্লবের মেঘাড়ম্বর, প্রেমদ্বন্দ্বের সঙ্গে একবন্ধনের দ্বারা বদ্ধ রোমের প্রচণ্ড আত্মবিচ্ছেদের সমরায়োজন । ক্লিয়োপাট্রার বিলাসকক্ষে বীণা বাজিতেছে, দূরে সমুদ্রতীর হইতে ভৈরবের সংহার-শৃঙ্গধানি তাহার সঙ্গে একমুরে মন্দ্রিত হইয়া উঠিতেছে । আদি এবং করুণ রসের সহিত কবি ঐতিহাসিক রস মিশ্ৰিত করিতেই তাহা এমন একটি চিত্তবিম্ফারক দূরত্ব ও বৃহত্ব প্রাপ্ত হইয়াছে । ইতিহাসবেত্তা মমসেন পণ্ডিত যদি শেকস্পীয়রের এই নাটকের উপরে প্রমাণের তীক্ষু আলোক নিক্ষেপ করেন তবে সম্ভবত ইহাতে অনেক কালবিরোধ-দোষ (anachronism ) অনেক ঐতিহাসিক ভ্রম বাহির হইতে পারে। কিন্তু শেকস্পীয়র পাঠকের মনে যে-মোহ উৎপাদন করিয়াছেন, ভ্রাস্ত বিকৃত ইতিহাসের স্বারাও যে একটি ঐতিহাসিক রসের অবতারণা করিয়াছেন তাহ ইতিহাসের নূতন তথ্য আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট হইবে না । সেইজন্য আমরা ইতিপূর্বে কোনো একটি সমালোচনায় লিখিয়াছিলাম, “ইতিহাসের সংস্রবে উপন্যাসে একটা বিশেষ রস সঞ্চার করে, ইতিহাসের সেই রসটুকুর প্রতি ঔপন্যাসিকের লোভ, তাহার সত্যের প্রতি তাহার কোনো খাতির নাই। কেহ যদি উপন্যাসে কেবল ইতিহাসের সেই বিশেষ গন্ধটুকু এবং স্বাদটুকুতে সন্তুষ্ট না হইয়া তাহা হইতে অখও ইতিহাস উদ্ধারে প্রবৃত্ত হন তবে তিনি ব্যঞ্জনের মধ্যে আস্ত জিরে-ধনে-হলুদ-সরষে সন্ধান করেন। মসলা আস্ত রাখিয়া যিনি ব্যঞ্জনে স্বাদ দিতে পারেন তিনি দিন, যিনি বাটিয়া ধাটিয়া একাকার করিয়া থাকেন তাহার সঙ্গেও আমার কোনো বিবাদ নাই, কারণ, স্বাদই এস্থলে লক্ষ্য, মসলা উপলক্ষমাত্র।” অর্থাৎ লেখক ইতিহাসকে অখও রাখিয়াই চলুন আর খও করিয়াই রাখুন সেই ঐতিহাসিক রসের অবতারণায় সফল হইলেই হইল ।