পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

86२ রবীন্দ্র-রচনাবলী কবিজীবনী কবি টেনিসনের পুত্র তাহার পরলোকগত পিতার চিঠিপত্র ও জীবনী বৃহৎ দুইখও পুস্তকে প্রকাশ করিয়াছেন। প্রাচীন কবিদের জীবনের বিস্তৃত বিবরণ খুজিয়া পাওয়া যায় না । জীবনীর শখ লোকের ছিল না—তাহা ছাড়া তখন বড়ো-ছোটো সকল লোকেই এখনকার চেয়ে অপ্রকাস্তে বাস করিত। চিঠিপত্র, খবরের কাগজ, সভাসমিতি,সাহিত্যের বাদবিরোধ, এমন প্রবল ছিল না। সুতরাং প্রতিভাশালী ব্যক্তির জীবনব্যাপারকে নানাদিক হইতে প্রতিফলিত দেখিবার স্বযোগ তখন ঘটিত না । অনেক ভ্রমণকারী বড়ো বড়ো নদীর উৎস খুজিতে দুর্গম স্থানে গিয়াছে। বড়ো কাব্যনদীর উৎস খুজিতেও কৌতুহল হয়। আধুনিক কবির জীবনচরিতে এই কৌতুহল নিবৃত্ত হইতে পারে এমন আশা মনে জন্মে। মনে হয় আধুনিক সমাজে কবির আর লুকাইবার স্থান নাই ; কাব্যস্রোতের উৎপত্তি যে-শিখরে, সে-পর্যন্ত রেলগাড়ি চলিতেছে। সেই আশা করিয়াই পরমাগ্রহে বৃহৎ দুইখও বই শেষ করা গেল। কিন্তু কবি কোথায়, কাব্যস্রোত কোন গুহা হইতে প্রবাহিত হইতেছে, তাহা তো খুজিয়া পাওয়া গেল না। ইহা টেনিসনের জীবনচরিত হইতে পারে, কিন্তু কবির জীবনচরিত নহে। আমরা বুঝিতে পারিলাম না, কবি কবে মানবহৃদয়সমুদ্রের মধ্যে জাল ফেলিয়া এত জ্ঞান ও ভাব আহরণ করিলেন এবং কোথায় বসিয়া বিশ্বসংগীতের স্বরগুলি তাহার বাশিতে অভ্যাস করিয়া লইলেন । _ কবি কবিতা যেমন করিয়া করিয়াছেন, জীবন তেমন করিয়া রচনা করেন নাই । তাহার জীবন কাব্য নহে। যাহার কর্মবীর, তাহারা নিজের জীবনকে নিজে সৃজন করেন। কবি যেমন ভাষার বাধার মধ্য হইতে ছন্দকে গাথিয়া তোলেন, যেমন সামান্ত ভাবকে অসামান্ত মুর এবং ছোটো কথাকে বড়ো অর্থ দিয়া থাকেন, তেমনি কর্মবীরগণ সংসারের কঠিন বাধার মধ্যে নিজের জীবনের ছদ্ম নির্মাণ করেন, এবং চারিদিকের ক্ষুদ্রতাকে অপূর্ব ক্ষমতাৰলে বড়ো করিয়া লন। তাহার হাতের কাছে যে-কিছু সামান্ত মালমসলা পান, তাহা দিয়াই নিজের জীবনকে মহৎ করেন এবং তাহাদিগকেও বৃহৎ করিয়া তোলেন। তাহাদের জীবনের কর্মই তাহাদের কাব্য, সেইজন্ত র্তাহাদের জীবনী মানুষ ফেলিতে পারে না।