পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 S3 রবীন্দ্র-রচনাবলী লেমনেড ও বরফ ভিক্ষে করে আনবে, এই তো ? তাতে ক্ষতিটা কী । যে সন্ন্যাসধর্মে বেলফুলের প্রতি বৈরাগ্য এবং ঠাণ্ড লেমনেডের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মায় সেটা কি খুব উচু দরের সন্ন্যাস । বিপিন । সাধারণ ভাষায় তো সন্ন্যাসধর্ম বলতে সেইরকমটাই বোঝায় । শ্ৰীশ । ঐ শোনো, তুমি কি মনে কর ভাষায় একটা কথার একটা বৈ অর্থ নেই। একজনের কাছে সন্ন্যাসী কথাটার যে অর্থ আর-একজনের কাছেও যদি ঠিক সেই অর্থই হয় তা হলে মন বলে একটা স্বাধীন পদাৰ্থ আছে কী করতে । বিপিন । তোমার মন সন্ন্যাসী কথাটার কী অর্থ করছেন আমার মন সেইটি শোনবার জন্য উৎসুক হয়েছেন । শ্ৰীশ । আমার সন্ন্যাসীর সাজ এইরকম - গলায় ফুলের মালা, গায়ে চন্দন, কানে কুণ্ডল, মুখে হাস্য । আমার সন্ন্যাসীর কােজ মানুষের চিত্ত-আকর্ষণ । সুন্দর চেহারা, মিষ্টি গলা, বক্তৃতায় অধিকার, এ-সমস্ত না থাকলে সন্ন্যাসী হয়ে উপযুক্ত ফল পাওয়া যায় না। রুচি বুদ্ধি কার্যক্ষমতা ও প্রফুল্লতা, সকল বিষয়েই আমার সন্ন্যাসীসম্প্রদায়কে গৃহস্থের আদর্শ হতে হবে । বিপিন। অর্থাৎ, একদল কার্তিককে ময়ুরের উপর চড়ে রাস্তায় বেরোতে হবে। শ্ৰীশ । ময়ূর না পাওয়া যায় ট্রাম আছে, পদব্রজেও নারাজ নই। কুমার-সভা মানেই তো কার্তিকের সভা । কিন্তু কার্তিক কি কেবল সুপুরুষ ছিলেন । তিনিই ছিলেন স্বর্গের সেনাপতি । বিপিন । লড়াইয়ের জন্যে র্তার দুটিমাত্ৰ হাত, কিন্তু বক্তৃতা করবার জন্যে র্তার তিনজোড়া মুখ । শ্ৰীশ । এর থেকে প্ৰমাণ হয় আমাদের আর্য পিতামহরা বাহুবল অপেক্ষা বাক্যাবলকে তিনগুণ বেশি বলেই জানতেন । আমিও পালোয়ানিকে বীরত্বের আদর্শ বলে মানি নে । বিপিন। ওটা বুঝি আমার উপর হল ? শ্ৰীশ । ঐ দেখো । মানুষকে অহংকারে কী রকম মাটি করে । তুমি ঠিক করে রেখেছ, পালোয়ান বললেই তোমাকে বলা হল । তুমি কলিযুগের ভীমসেন । আচ্ছা, এসো, যুদ্ধং দেহি । একবার বীরত্বের পরীক্ষা হয়ে যাক । এই বলিয়া দুই বন্ধু ক্ষণকালের জন্য লীলাচ্ছলে হাত-কাড়াকড়ি করিতে লাগিল বিপিন হঠাৎ “এইবার ভীমসেনের পতন’ বলিয়া ধাপ করিয়া শ্ৰীশের কেদারাটা অধিকার করিয়া তাহার উপরে দুই পা তুলিয়া দিল এবং উঃ অসহ্য তৃষ্ণ' বলিয়া লেমনেডের গ্লাসটি এক নিশ্বাসে খালি করিল তখন শ্ৰীশ তাড়াতাড়ি কুন্দযুকূলের মালাটি সংগ্ৰহ করিয়া কিন্তু বিজয়মাল্যটি আমার বলিয়া সেটা মাথায় জড়াইল এবং বেতের মোড়াটার উপরে বসিয়া পড়িল শ্ৰীশ । আচ্ছা ভাই, সত্যি বলে, একদল শিক্ষিত লোক যদি এইরকম সংসার পরিত্যাগ করে পরিপটি সজ্জায়, প্ৰফুল্ল প্ৰসন্ন মুখে, গানে এবং বক্তৃতায় ভারতবর্ষের চতুর্দিকে শিক্ষা বিস্তার করে বেড়ায় তাতে উপকার হয় কি না । বিপিন । আইডিয়াটা ভালো বটে । শ্ৰীশ । অর্থাৎ, শুনতে সুন্দর, কিন্তু করতে অসাধ্য। আমি বলছি অসাধ্য নয় এবং আমি দৃষ্টান্ত দ্বারা তার প্রমাণ করব। ভারতবর্ষে সন্ন্যাসধর্ম বলে একটা প্ৰকাণ্ড শক্তি আছে ; তার ছাই ঝেড়ে, তার বুলিটা কেড়ে নিয়ে, তার জটা মুড়িয়ে, তাকে সৌন্দর্যে এবং কর্মনিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত করাই চিরকুমার-সভার একমাত্র উদ্দেশ্য । ছেলে পড়ানো এবং দেশলাইয়ের কাঠি তৈরি করবার জন্যে আমাদের মতো লোক চিরজীবনের ব্ৰত অবলম্বন করে নি। বলো বিপিন, তুমি আমার প্রস্তাবে রাজি আছ কি না । বিপিন । তোমার সন্ন্যাসীর যেরকম চেহারা গলা এবং আসবাবের প্রয়োজন আমার তো তার কিছুই নেই। তবে তল্পিদার হয়ে পিছনে যেতে রাজি আছি। কানে যদি সোনার কুণ্ডল, অন্তত চোখে যদি সোনার চশমাটা পরে যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াও তা হলে একটা প্রহরীর দরকার, সে কাজটা আমার দ্বারা কতকটা চলতে পারবে ।