পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ (MoM3N পাচ ছেলের পর যখন এক কন্যা জন্মিল তখন বাপমায়ে অনেক আদর করিয়া তাহার নাম রাখিলেন নিরুপমা । এ গোষ্ঠীতে এমন শৌখিন নাম ইতিপূর্বে কখনো শোনা যায় নাই। প্রায় ঠাকুরদেবতার নামই প্ৰচলিত ছিল- গণেশ, কার্তিক, পার্বতী, তাহার উদাহরণ । এখন নিরুপমার বিবাহের প্রস্তাব চলিতেছে। তাহার পিতা রামসুন্দর মিত্র অনেক খোজ করেন। কিন্তু পাত্ৰ কিছুতেই মনের মতন হয় না। অবশেষে মস্ত এক রায়বাহাদুরের ঘরের একমাত্র ছেলেকে সন্ধান করিয়া ব্যক্তি কুরআছে। উক্ত রায়বাহাদুরের পৈতৃক বিষয়-আশয় যদিও অনেক হ্রাস হইয়া আসিয়াছে কিন্তু ঘর বরপক্ষ হইতে দশ হাজার টাকা পণ এবং বহুল দানসামগ্ৰী চাহিয়া বসিল । রামসুন্দর কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া তাহতেই সম্মত হইলেন ; এমন পাত্র কোনোমতে হাতছাড়া করা যায় না । কিছুতেই টাকার জোগাড় আর হয় না। বাধা দিয়া, বিক্রয় করিয়া, অনেক চেষ্টাতেও হাজার ছয়-সাত বাকি রহিল । এ দিকে বিবাহের দিন নিকট হইয়া আসিয়াছে । অবশেষে বিবাহের দিন উপস্থিত হইল। নিতান্ত অতিরিক্ত সুদে একজন বাকি টাকাটা ধার দিতে স্বীকার করিয়াছিল। কিন্তু সময়কালে সে উপস্থিত হইল না । বিবাহসভায় একটা তুমুল গোলযোগ বাধিয়া গেল । রামসুন্দর আমাদের রায়বাহাদুরের হাতে-পায়ে ধরিয়া বলিলেন, “শুভকাৰ্য সম্পন্ন হইয়া যাক, আমি নিশ্চয়ই টাকাটা শোধ করিয়া দিব ।” রায়বাহাদুর বলিলেন, “টাকা হাতে না পাইলে বর সভাস্থ করা যাইবে না ।” এই দুর্ঘটনায় অন্তঃপুরে একটা কান্না পড়িয়া গেল। এই গুরুতর বিপদের যে মূল কারণ সে চেলি পরিয়া, গহনা পরিয়া, কপালে চন্দন লেপিয়া, চুপ করিয়া বসিয়া আছে। ভাবী শ্বশুরকুলের প্রতি যে তাহার খুব একটা ভক্তি কিংবা অনুরাগ জমিতেছে, তাহা বলা যায় না । ইতিমধ্যে একটা সুবিধা হইল। বার সহসা তাহার পিতৃদেবের অবাধ্য হইয়া উঠিল। সে বাপকে বলিয়া বসিল, “কেনাবেচা-দরদামের কথা আমি বুঝি না, বিবাহ করিতে আসিয়াছি বিবাহ করিয়া যাইব ।” বাপ যাহাকে দেখিল তাহাকেই বলিল, “দেখেছেন মহাশয়, আজকালকার ছেলেদের ব্যবহার ” দুই-একজন প্ৰবীণ লোক ছিল, তাহারা বলিল, “শাস্ত্ৰশিক্ষা নীতিশিক্ষা একেবারে নাই, কাজেই ।” বর্তমান শিক্ষার বিষময় ফল নিজের সন্তানের মধ্যে প্রত্যক্ষ করিয়া রায়বাহাদুর হতোদ্যম হইয়া বসিয়া রহিলেন । বিবাহ একপ্রকার বিষয় নিরানন্দ ভাবে সম্পন্ন হইয়া গেল । শ্বশুরবাড়ি যাইবার সময় নিরুপমাকে বুকে টানিয়া লইয়া বাপ আর চােখের জল রাখিতে পারিলেন না। নিরু জিজ্ঞাসা করিল, “তারা কি আর আমাকে আসতে দেবে না, বাবা।” রামসুন্দর বলিলেন, “কেন আসতে দেবে না, মা । আমি তোমাকে নিয়ে আসিব ।” রামসুন্দর প্রায়ই মেয়েকে দেখিতে যান। কিন্তু বেহাইবাড়িতে র্তার কোনো প্ৰতিপত্তি নাই। চাকারগুলো পর্যন্ত তাহাকে নিচু নজরে দেখে । অন্তঃপুরের বাহিরে একটা স্বতন্ত্র ঘরে পাঁচ মিনিটের জন্য কোনোদিন-বা মেয়েকে দেখিতে পান, কোনোদিন-বা দেখিতে পান না । কুটুম্বগৃহে এমন করিয়া অপমান তো সহা যায় না। রামসুন্দর স্থির করিলেন যেমন করিয়া হউক টাকাটা শোধ করিয়া দিতে হইবে । কিন্তু যে ঋণভার কঁধে চাপিয়াছে, তাহারই ভার সামলানো দুঃসাধ্য। খরচপত্রের অত্যন্ত টানাটানি trl 19Š