পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

5NSB (06 কলামটা দাদার হাতে দিলেন । গুরুচরণ নিজীবি হন্তে যাহা সই করিলেন, তাহা কতকগুলা কম্পিত বক্ররেখা কি তাহার নাম, বুঝা দুঃসাধ্য। পান্তাভাত খাইয়া যখন স্ত্রী আসিলেন তখন গুরুচরণের বাকুরোধ হইয়াছে দেখিয়া স্ত্রী কঁদিতে লাগিলেন । যাহারা অনেক আশা করিয়া বিষয় হইতে বঞ্চিত হইয়াছে তাহারা বলিল “মায়াকান্না’ । কিন্তু সেটা বিশ্বাসযোগ্য নহে । উইলের বৃত্তান্ত শুনিয়া নবদ্বীপের মা ছুটিয়া আসিয়া বিষম গোল বাধাইয়া দিল— বলিল, “মরণকালে বুদ্ধিনাশ হয়। এমন সোনার-চাদ ভাইপো থাকিতে-” রামকানাই যদিও স্ত্রীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করিতেন- এত অধিক যে তাহাকে ভাষান্তরে ভয় বলা যাইতে পারে- কিন্তু তিনি থাকিতে পারিলেন না, ছুটিয়া আসিয়া বলিলেন, “মেজেবিউ, তোমার তো বুদ্ধিনাশের সময় হয় নাই, তবে তোমার এমন ব্যবহার কেন । দাদা গেলেন, এখন আমি তো রহিয়া গেলাম, তোমার যা-কিছু বক্তব্য আছে, অবসরমত আমাকে বলিয়ো, এখন ঠিক সময় নয়।” নবদ্বীপ সংবাদ পাইয়া যখন আসিল তখন তাহার জ্যাঠামহাশয়ের কাল হইয়াছে। নবদ্বীপ মৃত ব্যক্তিকে শাসইয়া কহিল, “দেখিব মুখাগ্নি কে করে- এবং শ্ৰাদ্ধশান্তি যদি করি তো আমার নাম নবদ্বীপ নয় । গুরুচরণ লোকটা কিছুই মানিত না । সে ডফ সাহেবের ছাত্র ছিল । শাস্ত্ৰমতে যেটা সর্বাপেক্ষা অখাদ্য সেইটাতে তার বিশেষ পরিতৃপ্তি ছিল। লোকে যদি তাহাকে ক্রিশচান বলিত, সে জিভ কাটিয়া বলিত, “রাম, আমি যদি ক্রিশচান হই তো গোমাংস খাই ।” জীবিত অবস্থায় যাহার এই দশা, সদ্যমৃত অবস্থায় সে-যে পিশুনাশ-আশঙ্কায় কিছুমাত্র বিচলিত হইবে, এমন সম্ভাবনা নাই । কিন্তু উপস্থিতমত ইহা ছাড়া আর-কোনো প্ৰতিশোধের পথ ছিল না । নবদ্বীপ একটা সত্ত্বনা পাইল যে, লোকটা পরকালে গিয়া মরিয়া থাকিবে । যতদিন ইহলোকে থাকা যায় জ্যাঠামহাশয়ের বিষয় না পাইলেও কোনোক্রমে পেট চলিয়া যায়, কিন্তু জ্যাঠামহাশয় যে-লোকে গেলেন সেখানে ভিক্ষা করিয়া পিণ্ড মেলে না। বঁচিয়া থাকিবার অনেক সুবিধা আছে । গিয়াছেন । এই তাহার উইল । লোহার সিন্দুকে যত্নপূর্বক রাখিয়া দিয়ে ।” বিধবা। তখন মুখে মুখে দীর্ঘপদ রচনা করিয়া উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করিতেছিলেন, দুই-চারিজন দাসীও তাহার সহিত স্বর মিলাইয়া মধ্যে মধ্যে দুই-চারিটা নুতন শব্দ যোজনাপূর্বক শোকসংগীতে সমস্ত পল্লীর নিদ্ৰা দূর করিতেছিল। মাঝে হইতে এই কাগজখণ্ড আসিয়া একপ্রকার লয়ভঙ্গ হইয়া গেল এবং ভাবেরও পূর্বাপর যোগ রহিল না । ব্যাপারটা নিম্নলিখিত-মতো অসংলগ্ন আকার ধারণ করিল - “ওগো, আমার কী সর্বনাশ হল গো, কী সর্বনাশ হল । আচ্ছা ঠাকুরপো, লেখাটা কার । তোমার বুঝি ? ওগো, তেমন যত্ন করে আমাকে আর কে দেখবে, আমার দিকে কে মুখ তুলে চাইবে গো — তোরা একটুকু থাম, মেলা চেঁচাস নে, কথাটা শুনতে দে ; ওগো, আমি কেন আগে গেলুম না গো— আমি কেন বেঁচে রইলুম।” রামকানাই মনে মনে নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “সে আমাদের কপালের দোষ ।” বাড়ি ফিরিয়া গিয়া নবদ্বীপের মা রামকানাইকে লইয়া পড়িলেন । বোঝাই গাড়িসমেত খাদের মধ্যে পড়িয়া হতভাগ্য বলদ গাড়োয়ানের সহস্র গুতা খাইয়াও অনেকক্ষণ যেমন নিরুপায় নিশ্চল ভাবে দাড়াইয়া থাকে, রামকানাই তেমনি অনেকক্ষণ চুপ করিয়া সহ্য করিলেন- অবশেষে কাতরস্বরে কহিলেন, “আমার অপরাধ কী । আমি তো দাদা নাই ।” নবদ্বীপের মা ফোস করিয়া উঠিয়া বলিলেন, “না, তুমি বড়ো ভালো মানুষ, তুমি কিছু বোঝা না ; দাদা বললেন “লেখ, ভাই অমনি লিখে গেলেন । তোমরা সবাই সমান । তুমিও সময়কালে ঐ কীর্তি করবে বলে বসে আছ । আমি মলেই কোন পোড়ারমুখী ডাইনীকে ঘরে আনবে- আর আমার সোনার-চাদ নবদ্বীপকে পাথারে ভাসাবে । কিন্তু সেজন্যে ভেবো না, আমি শিগগির মরছি নে ৷” এইরূপে রামকানাইয়ের ভাবী অত্যাচার আলোচনা করিয়া গৃহিণী উত্তরোত্তর অধিকতর অসহিষ্ণু হইয়া উঠিতে লাগিলেন । রামকানাই নিশ্চয় জানিতেন, যদি এইসকল উৎকট কাল্পনিক আশঙ্কা নিবারণ-উদেশে