পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ሱ Obr রবীন্দ্র-রচনাবলী এমন সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু এক-একটি স্বভাব আছে যে, একটি ছোটো খেয়াল কিংবা একটি ছোটাে শিশু কিংবা একটি অকৃতজ্ঞ বন্ধুর নিকটে অতি সহজে আপনাকে সম্পূর্ণ বিসর্জন করে ; এই বিপুল পৃথিবীতে একটিমাত্র মেহের কারবারে জীবনের সমস্ত মূলধন সমর্পণ করিয়া নিশ্চিন্তু থাকে, তার পরে হয়তো সামান্য উপস্বত্বে পরম সন্তোষে জীবন কাটাইয়া দেয় কিংবা সহসা একদিন প্ৰভাতে সমস্ত ঘরবাড়ি বিক্রয় করিয়া কঙাল হইয়া পথে গিয়া দাড়ায় । হিমাংশুর বয়স যখন আর-একটু বাড়িল, তখন বয়স এবং সম্পর্কের বিস্তর তারতম্য সত্ত্বেও বনমালীর সহিত তাহার যেন একটি বন্ধুত্বের বন্ধন স্থাপিত হইল। উভয়ের মধ্যে যেন ছোটোেবড়ো কিছু ছিল না । এইরূপ হইবার একটু কারণও ছিল । হিমাংশু লেখাপড়া করিত এবং স্বভাবতই তাহার জ্ঞানস্পাহা অত্যন্ত প্ৰবল ছিল । বই পাইলেই পড়িতে বসিত, তাহাতে অনেক বাজে বই পড়া হইয়াছিল বটে, কিন্তু যেমন করিয়াই হউক, চারি দিকেই তাহার মনের একটি পরিণতিসাধন হইয়াছিল । বনমালী বিশেষ একটু শ্রদ্ধার সহিত তাহার কথা শুনিত, তাহার পরামর্শ লাইত, তাহার সহিত ছোটোেবড়ো সকল কথার আলোচনা করিত, কোনো বিষয়েই তাহাকে বালক বলিয়া অগ্রাহ্য করিত না । হৃদয়ের সর্বপ্রথম মেহরস দিয়া যাহাকে মানুষ করা গিয়াছে, বয়সকালে যদি সে বুদ্ধি, জ্ঞান এবং উন্নত স্বভাবের জন্য শ্রদ্ধার অধিকারী হয়, তবে তাহার মতো এমন পরমপ্ৰিয়বস্তু পৃথিবীতে আর পাওয়া যায় না। বাগানের শাখাও হিমাংশুর ছিল । কিন্তু এ-বিষয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে প্ৰভেদ ছিল । বনমালীর ছিল হৃদয়ের শখ, হিমাংশুর ছিল বুদ্ধির শখ। পৃথিবীর এই কোমল গাছপালাগুলি, এই অচেতন জীবনরাশি, যাহারা যত্নের কোনো লালসা রাখে না। অথচ যত্ন পাইলে ঘরের ছেলেগুলির মতো বাড়িয়া উঠে, যাহারা মানুষের শিশুর চেয়েও শিশু, তাহাদিগকে সযত্নে মানুষ করিয়া তুলিবার জন্য বনমালীর একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ছিল। কিন্তু হিমাংশুর গাছপালার প্রতি একটি কৌতুহলদৃষ্টি ছিল । অন্ধুর গজাইয়া উঠে, কিশলয় দেখা দেয়, কুঁড়ি ধরে, ফুল ফুটিয়া উঠে, ইহাতে তাহার একান্ত মনোযোগ আকর্ষণ করিত । গাছের বীজ বপন, কলম করা, সার দেওয়া, চানক তৈয়ারি প্রভৃতি সম্বন্ধে হিমাংশুর মাথায় বিবিধ -পরামর্শের উদয় হইত এবং বনমালী অত্যন্ত আনন্দের সহিত তাহা গ্রহণ করিত। এই উদ্যান খণ্ডটুকু লইয়া আকৃতি প্রকৃতির যতপ্রকার সংযোগ-বিয়োগ সম্ভব, তাহা উভয়ে মিলিয়া সাধন করিত। দ্বারের সম্মুখে বাগানের উপরেই একটি বাধানো বেদির মতো ছিল । চারটে বাজিলেই একটি পাতলা জামা পরিয়া, একটি কেঁচানো চাদর কাধের উপর ফেলিয়া, গুড়গুড়ি লইয়া, বনমালী সেইখানে ছায়ায় গিয়া বসিত । কোনো বন্ধুবান্ধব নাই, হাতে একখানি বই কিংবা খবরের কাগজ নাই ; বসিয়া বসিয়া তামাক টানিত, এবং আড়চক্ষে উদাসীনভাবে কখনো-বা দক্ষিণে কখনো বামে দৃষ্টিপাত করিত । এমনি করিয়া সময় তাহার গুড়গুড়ির বাস্পকুণ্ডলীর মতো ধীরে ধীরে অত্যন্ত লঘুভাবে উড়িয়া যাইত, ভাঙিয়া যাইত, মিলাইয়া যাইত, কোথাও কোনো চিহ্ন রাখিত না । অবশেষে যখন হিমাংশু স্কুল হইতে ফিরিয়া, জল খাইয়া হাতমুখ ধুইয়া দেখা দিত, তখন তাড়াতাড়ি গুড়গুড়ির নল ফেলিয়া বনমালী উঠিয়া পড়িত । তখনই তাহার আগ্রহ দেখিয়া বুঝা যাইত, এতক্ষণ ধৈর্যসহকারে সে কাহার প্রত্যাশায় বসিয়া ছিল । তাহার পরে দুইজনে বাগানে বেড়াইতে বেড়াইতে কথা । অন্ধকার হইয়া আসিলে দুইজনে বেঞ্চের উপর বসিত- দক্ষিণের বাতাস গাছের পাতা মর্মরিত করিয়া বহিয়া যাইত ; কোনোদিন-বা বাতাস বহিত না, গাছপালাগুলি ছবির মতো স্থির দাড়াইয়া রহিত, মাথার উপরে আকাশ ভরিয়া তারাগুলি জ্বলিতে থাকিত । হিমাংশু কথা কহিত, বনমালী চুপ করিয়া শুনিত । যাহা বুঝিত না, তাহাও তাহার ভালোলাগিত ; যে-সকল কথা আর-কাহারও নিকট হইতে অত্যন্ত বিরক্তিজনক লাগিতে পারিত, সেই কথাই হিমাংশুর মুখে বড়ো কৌতুকের মনে হইত। এমন শ্রদ্ধাবান বয়স্ক শ্রোতা পাইয়া হিমাংশুর বক্তৃতাশক্তি স্মৃতিশক্তি কল্পনাশক্তির সবিশেষ পরিতৃপ্তি লাভ হইত। সে কতক-বা পড়িয়া বলিত, কতক-বা ভাবিয়া বলিত, কতক-বা উপস্থিতমত তাহার মাথায় জোগাইত এবং অনেক সময়ে কল্পনার সহায়তায় জ্ঞানের অভাব ঢাকা দিয়া লইত । অনেক ঠিক কথা বলিত, অনেক বেঠিক কথাও বলিত, কিন্তু বনমালী গভীরভাবে শুনিত, মাঝে