পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(RO রবীন্দ্র-রচনাবলী বিশেষত তাহারা খুব একটা যুক্তি দেখাইল ; বলিল, একটা বউ গেলে অনতিবিলম্বে আর-একটা বউ ংগ্ৰহ করা যায়, কিন্তু বাপ গেলে দ্বিতীয় বাপ মাথা খুঁড়িলেও পাওয়া যায় না। যুক্তি খুব পাকা সন্দেহ নাই ; কিন্তু আমার বিশ্বাস, বৃন্দাবনের মতো ছেলে এ যুক্তি শুনিলে অনুতপ্ত না হইয়া বরং কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইত। বৃন্দাবনের বিদায়কালে তাহার পিতা যে অধিক মনঃকষ্ট পাইয়াছিলেন তাহা বোধ হয় না। বৃন্দাবন যাওয়াতে এক তো ব্যয়সংক্ষেপ হইল, তাহার উপর যজ্ঞনাথের একটা মহা ভয় দূর হইল, বৃন্দাবন কখন তাহাকে বিষ খাওয়াইয়া মারে এই আশঙ্কা তাহার সর্বদাই ছিল— যে অত্যাক্স আহার ছিল তাহার সহিত বিষেরকল্পনা সর্বদা লিপ্ত হইয়া থাকিত । বন্ধুর মৃত্যুর পর এ আশঙ্কা কিঞ্চিৎ কমিয়াছিল এবং পুত্রের বিদায়ের পর অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ হইল । কেবল একটি বেদনা মনে বাজিয়াছিল। যজ্ঞনাথের চারি বৎসর বয়স্ক নাতি গোকুলচন্দ্রকে বৃন্দাবন সঙ্গে লইয়া গিয়াছিল। গোকুলের খাওয়া-পরার খরচ অপেক্ষাকৃত কম, সুতরাং তাহার প্রতি যজ্ঞনাথের স্নেহ অনেকটা নিষ্কণ্টক ছিল । তথাপি বৃন্দাবন যখন তাহাকে নিতান্তই লইয়া গেল তখন অকৃত্রিম শোকের মধ্যেও খরচ কমে এবং বৎসরে কতটা দাড়ায়, এবং যে টাকাটা সাশ্রয় হয় তাহা কত টাকার সুন্দ । কিন্তু তবু শূন্য গৃহে গোকুলচন্দ্রের উপদ্রব না থাকাতে গৃহে বাস করা কঠিন হইয়া উঠিল। আজকাল যজ্ঞনাথের এমনি মুশকিল হইয়াছে, পূজার সময়ে কেহ ব্যাঘাত করে না, খাওয়ার সময় কেহ কড়িয়া খায় না, হিসাব লিখিবার সময় দোয়াত লইয়া পালায় এমন উপযুক্ত লোক কেহ নাই । নিরুপদ্রবে। স্নানাহার সম্পন্ন করিয়া তাহার চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিতে লাগিল । মনে হইল যেন মৃত্যুর পরেই লোকে এইরূপ উৎপাতহীন শূন্যতা লাভ করে ; বিশেষত বিছানার কাথায় র্তাহার নাতির কৃত ছিদ্র এবং বসিবার মাদুরে উক্ত শিল্পীঅঙ্কিত মসীচিহ্ন দেখিয়া তাহার হৃদয় আরো অশান্ত হইয়া উঠিত । সেই অমিতাচারী বালকটি দুই বৎসরের মধ্যেই পরিবার ধুতি সম্পূর্ণ অব্যবহার্য করিয়া তুলিয়াছিল বলিয়া পিতামহের নিকট বিস্তর তিরস্কার সহ্য করিয়াছিল ; এক্ষণে তাহার শয়নগৃহে সেই শতগ্রস্থিবিশিষ্ট মলিন পরিত্যক্ত চীরখণ্ড দেখিয়া তাহার চক্ষু ছলছল করিয়া আসিল ; সেটি পলিতা-প্ৰস্তুত-করণ কিংবা অন্য কোনো গাৰ্হস্থ্য ব্যবহারে না লাগাইয়া যত্নপূর্বক সিন্দুকে তুলিয়া রাখিলেন এবং মনে মনে প্ৰতিজ্ঞা করিলেন যদি গোকুল ফিরিয়া আসে এবং এমন-কি, বৎসরে একখানি করিয়া ধুতিও নষ্ট করে তথাপি তাহাকে তিরস্কার করিবেন না । কিন্তু গোকুল ফিরিল না এবং যজ্ঞনাথের বয়স যেন পূর্বাপেক্ষা অনেক শীঘ্র শীঘ্ৰ বাড়িয়া উঠিল এবং শূন্য গৃহ প্রতিদিন শূন্যতর হইতে লাগিল । যজ্ঞনাথ আর ঘরে স্থির থাকিতে পারেন না । এমন-কি, মধ্যাহ্নে যখন সকল সম্রান্ত লোকই আহারান্তে নিদ্রাসুখ লাভ করে যজ্ঞনাথ হকা-হস্তে পাড়ায় পাড়ায় ভ্ৰমণ করিয়া বেড়ান। তাহার এই নীরব মধ্যাহ্ন ভ্রমণের সময় পথের ছেলেরা খেলা পরিত্যাগপূর্বক নিরাপদ স্থানে পলায়ন করিয়া তাহার মিতব্যয়িতা সম্বন্ধে স্থানীয় কবি-রচিত বিবিধ ছন্দোবদ্ধ রচনা শ্রুতিগম্য উচ্চৈঃস্বরে আবৃত্তি করিত। পাছে আহারের ব্যাঘাত ঘটে বলিয়া তাহার পিতৃদত্ত নাম উচ্চারণ করিতে কেহ সাহস করিত না, এইজন্য সকলেই স্বেচ্ছামতে তাহার নূতন নামকরণ করিত । বুড়েরা তঁহাকে যজ্ঞানাশ বলিতেন, কিন্তু ছেলেরা কেন যে তঁহাকে “চামচিকে বলিয়া ডাকিত তাহার স্পষ্ট কারণ পাওয়া যায় না । বোধ হয় তাহার রক্তহীন শীর্ণ চর্মের সহিত উক্ত খোচরের কোনোপ্রকার শরীরগত সাদৃশ্য ছিল । দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ একদিন এইরূপে আশ্ৰতরুচ্ছায়াশীতল গ্রামের পথে যজ্ঞনাথ মধ্যাহ্নে বেড়াইতেছিলেন ; দেখিলেন একজন অপরিচিত বালক গ্রামের ছেলেদের সর্দার হইয়া উঠিয়া একটি সম্পূর্ণ নূতন উপদ্রবের পন্থা নির্দেশ করিতেছে। অন্যান্য বালকেরা তাহার চরিত্রের বল এবং কল্পনার নূতনত্বে অভিভূত হইয়া কায়মনে তাহার বশ মানিয়াছে।