পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

QQ° ब्रतीक-द्धान्दळेी তৃতীয় পরিচ্ছেদ জুলিখা আমিনার অবস্থা চিন্তা করিয়া ভারি বিমর্ষ হইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। এমন সময় হঠাৎ ধূপ করিয়া একটা লফের শব্দ হইল এবং পশ্চাৎ হইতে কে একজন জুলিখার চোখ টিপিয়া ধরিল । জুলিখা ত্ৰস্ত হইয়া কহিল, “কেও।” স্বর শুনিয়া যুবক চোখ ছাড়িয়া দিয়া সম্মুখে আসিয়া দাড়াইল, জুলিখার মুখের দিকে চাহিয়া অম্লানবদনে কহিল, “তুমি তো তিন্নি নও।' যেন জুলিখা বরাবর আপনাকে “তিন্নি বলিয়া চালাইবার চেষ্টা করিতেছিল, কেবল যুবকের অসামান্য তীক্ষাবুদ্ধির কাছে সমস্ত চাতুরী প্ৰকাশ হইয়া পড়িয়াছে। জ্বলিখা বসন সংবরণ করিয়া দৃপ্তভাবে উঠিয়া দাড়াইয়া দুই চক্ষে অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করিল। জিজ্ঞাসা করিল, “কে তুমি ” যুবক কহিল, “তুমি আমাকে চেন না। তিন্নি জানে। তিন্নি কোথায় ।” তিন্নি গোলযোগ শুনিয়া বাহির হইয়া আসিল । জুলিখার রোষ এবং যুবকের হতবুদ্ধি বিস্মিতমুখ দেখিয়া আমিনা উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল । কহিল, “দিদি, ওর কথা তুমি কিছু মনে করিয়ো না। ও কি মানুষ, ও একটা বনের মৃগ । যদি কিছু বেয়াদপি করিয়া থাকে। আমি উহাকে শাসন করিয়া দিব। — দালিয়া, তুমি কী করিয়াছিলে ।” যুবক তৎক্ষণাৎ কহিল, ‘চোখ টিপিয়া ধরিয়াছিলাম। আমি মনে করিয়াছিলাম। তিন্নি। কিন্তু ও তো তিন্নি a তিন্নি সহসা দুঃসহ ক্ৰোধ প্রকাশ করিয়া উঠিয়া কহিল, ‘ফের ! ছোটাে মুখে বড়ো কথা ! কবে তুমি তিন্নির চোখ টিপিয়াছ। তোমার তো সাহস কম নয়।” যুবক কহিল, ‘চােখ টিপিতে তো খুব বেশি সাহসের দরকার করে না ; বিশেষত পূর্বের অভ্যাস থাকিলে । কিন্তু সত্য বলিতেছি তিন্নি, আজ একটু ভয় পাইয়া গিয়াছিলাম।” বলিয়া গোপনে জুলিখার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া আমিনার মুখের দিকে চাহিয়া নিঃশব্দে হাসিতে द्वनब्नि | আমিনা কহিল, “না, তুমি অতি বর্বর, শাহজাদীর সম্মুখে দাড়াইবার যোগ্য নও । তোমাকে সহবত শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক । দেখো, এমনি করিয়া সেলাম করো ।” বলিয়া আমিনা তাহার যৌবনমঞ্জরিত তনুলতা অতি মধুর ভঙ্গিতে নত করিয়া জুলিখাকে সেলাম করিল। যুবক বহুকষ্টে তাহার নিতান্ত অসম্পূর্ণ অনুকরণ করিল। বলিল, “এমনি করিয়া তিন পা পিছু হঠিয়া আইস ।” যুবক পিছু হঠিয়া আসিল । “আবার সেলাম করো ।” আবার সেলাম করিল । এমনি করিয়া পিছু হঠাইয়া, সেলাম করাইয়া, আমিনা যুবককে কুটিরের দ্বারের কাছে লইয়া গেল । কহিল, “ঘরে প্রবেশ করো।” যুবক ঘরে প্রবেশ করিল। আমিনা বাহির হইতে ঘরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়া কহিল, ‘একটু ঘরের কাজ করে । আগুনটা জ্বালাইয়া রাখো ৷’’ বলিয়া দিদির পাশে আসিয়া বসিল । কহিল, ‘দিদি, রাগ করিস নে ভাই, এখানকার মানুষগুলো এইরকমের । হাড় জ্বালাতন হইয়া গেছে।’ কিন্তু আমিনার মুখে কিংবা ব্যবহারে তাহার লক্ষণ কিছুই প্রকাশ পায় না । বরং অনেক বিষয়ে এখানকার মানুষের প্রতি তাহার কিছু অন্যায় পক্ষপাত দেখা যায়। জুলিখা যথাসাধ্য রাগ প্রকাশ করিয়া কহিল, ‘বাস্তবিক আমিনা, তোর ব্যবহারে আমি আশ্চর্য হইয়া গেছি। একজন বাহিরের যুবক আসিয়া তোকে স্পর্শ করিতে পারে এত বড়ো তাহার সাহস ।” আমিনা দিদির সহিত যোগ দিয়া কহিল, “দেখ দেখি বোন। যদি কোনো বাদশাহ কিংবা নবাবের ছেলে এমন ব্যবহার করিত, তবে তাহাকে অপমান করিয়া দূর করিয়া দিতাম।” জুলিখার ভিতরের হাসি আর বাধা মানিল না ; হাসিয়া উঠিয়া কহিল, ‘সত্য করিয়া বলা দেখি আমিনা, তুই যে বলিতেছিলি পৃথিবীটা তোর বড়ো ভালো লাগিতেছে, সে কি ঐ বর্বর যুবকটার জন্য ।”