পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Teg (፩ Sዒ আমিনা কহিল, ‘তা, সত্য কথা বলি দিদি, ও আমার অনেক উপকার করে । ফুলটা ফলটা পাড়িয়া দেয়, শিকার করিয়া আনে, একটা-কিছু কাজ করিতে ডাকিলে ছুটিয়া আসে । অনেকবার মনে করি উহাকে শাসন করিব । কিন্তু সে চেষ্টা বৃথা । যদি খুব চোখ রাঙাইয়া বলি, দালিয়া, তোমার প্রতি আমি ভারি অসন্তুষ্ট হইয়াছি- দালিয়া মুখের দিকে চাহিয়া পরম কৌতুকে নিঃশব্দে হাসিতে থাকে । এদের দেশে পরিহাস বোধ করি এইরকম ; দু-ঘা মারিলে ভারি খুশি হইয়া উঠে, তাহাও পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি। ঐ দেখো-না, ঘরে পুরিয়া রাখিয়াছি— বড়ো আনন্দে আছে, দ্বার খুলিলেই দেখিতে পাইব মুখ চক্ষু লাল করিয়া মনের সুখে আগুনে ফু দিতেছে । ইহাকে লইয়া কী করি বলা তো বোন। আমি তো আর পারিয়া উঠি না ।” জুলিখা কহিল, “আমি চেষ্টা দেখিতে পারি।” আমিনা হাসিয়া মিনতি করিয়া বলিল, “তোর দুটি পায়ে পড়ি বোন । ওকে আর তুই কিছু বলিস না ।” এমন করিয়া বলিল, যেন ঐ যুবকটি আমিনার একটি বড়ো সাধের পোষা হরিণ, এখনো তাহার বন্য স্বভাব দূর হয় নাই— পাছে অন্য কোনো মানুষ দেখিলে ভয় পাইয়া নিরুদ্দেশ হয় এমন আশঙ্কা আছে। এমন সময় ধীবর আসিয়া কহিল, ‘আজ দালিয়া আসে নাই তিন্নি ?” ‘আসিয়াছে।” kl.

  • কোথায় গেল ।”

“সে বড়ো উপদ্রব করিতেছিল, তাই তাহাকে ঐ ঘরে পুরিয়া রাখিয়াছি।” থাকে। বেশি শাসন করিস না। দালিয়া কাল এক থলু দিয়া আমার কাছে তিনটি মাছ লইয়াছিল।' (থলু অর্থে স্বর্ণমুদ্রা) আমিনা কহিল, ‘ভাবনা নাই বুঢ়া, আজ আমি তাহার কাছে দুই থলু আদায় করিয়া দিব, একটিও মাছ gिठ श्द ना ।' বৃদ্ধ তাহার পালিত কন্যার এত অল্প বয়সে এমন চাতুরী এবং বিষয়বুদ্ধি দেখিয়া পরম গ্ৰীত হইয়া তাহার মাথায় সস্নেহ হাত বুলাইয়া চলিয়া গেল । চতুর্থ পরিচ্ছেদ আশ্চর্য এই, দালিয়ার আসা যাওয়া সম্বন্ধে জুলিখার ক্রমে আর আপত্তি রহিল না। ভাবিয়া দেখিলে, ইহাতে আশ্চর্য নাই। কারণ, নদীর যেমন এক দিকে স্রোত এবং আর-এক দিকে কুল, রমণীর সেইরূপ হৃদয়াবেগ এবং লোকলজ । কিন্তু, সভ্যসমাজের বাহিরে আরাকানের প্রান্তে এখানে লোক কোথায় । এখানে কেবল ঋতুপর্যায়ে তরু মুঞ্জরিত হইতেছে ; এবং সম্মুখের নীলা নদী বর্ষায় স্ফীত, শরতে স্বচ্ছ এবং গ্ৰীষ্মে ক্ষীণ হইতেছে ; পাখির উচ্ছসিত কণ্ঠস্বরে সমালোচনার লেশমাত্র নাই ; এবং দক্ষিণবায়ু মাঝে মাঝে পর্যপারের গ্রাম হইতে মানবচক্রের গুঞ্জনধ্বনি বহিয়া আনে, কিন্তু কানাকানি আনে না । পতিত অট্টালিকার উপরে ক্রমে যেমন অরণ্য জন্মে। এখানে কিছুদিন থাকিলে সেইরূপ প্রকৃতির গোপন আক্রমণে লৌকিকতার মানবনির্মিত দৃঢ় ভিত্তি ক্ৰমে অলক্ষিতভাবে ভাঙিয়া যায় এবং চতুর্দিকে প্রাকৃতিক জগতের সহিত সমস্ত একাকার হইয়া আসে । দুটি সমযোগ্য নরনারীর মিলানদৃশ্য দেখিতে রমণীর যেমন সুন্দর লাগে এমন আর-কিছু নয়। এত রহস্য, এত সুখ, এত অতলস্পর্শ কৌতুহলের বিষয় তাহার পক্ষে আর-কিছুই হইতে পারে না । অতএব এই বর্বরকুটিরের মধ্যে নির্জন দারিদ্র্যের ছায়ায় যখন জুলিখার কুলগর্ব। এবং লোকমর্যাদার ভােব আপনিই শিথিল হইয়া আসিল তখন পুম্পিত কৈলুতরুচ্ছায়ে আমিনা এবং দালিয়ার মিলনের এই এক মনোহর খেলা দেখিতে তাহার বড়ো আনন্দ হইত। বোধ করি তাহারও তরুণ হৃদয়ের একটা অপরিতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা জাগিয়া উঠিত এবং তাঁহাকে সুখে দুঃখে৷ চঞ্চল করিয়া তুলিত । অবশেষে এমন হইল, কোনোদিন যুবকের আসিতে বিলম্ব হইলে আমিনা যেমন উৎকণ্ঠিত হইয়া থাকিত জুলিখাও তেমনি আগ্রহের সহিত প্রতীক্ষা করিত এবং উভয়ে একত্র হইলে, trivos