পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G\OO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী চাহিল, দালিয়া চুপ করিয়া হাসামুখে উভয়ের প্রতি চাহিয়া রহিল- ছুরিও তাহার খাপের মধ্য হইতে একটুখানি মুখ বাহির করিয়া এই রঙ্গ দেখিয়া ঝিকমিক করিয়া হাসিতে লাগিল। I'A S SIbr কঙ্কাল আমরা তিন বাল্যসঙ্গী যে ঘরে শয়ন করিতাম তাহার পাশের ঘরের দেয়ালে একটি আস্ত নরকঙ্কাল ঝুলানো থাকিত । রাত্রে বাতাসে তাহার হাড়গুলা খটখট শব্দ করিয়া নড়িত। দিনের বেলায় আমাদিগকে সেই হাড় নাড়িতে হইত। আমরা তখন পণ্ডিত-মহাশয়ের নিকট মেঘনাদবধ এবং ক্যাম্বেল স্কুলের এক ছাত্রের কাছে অস্থিবিদ্যা পড়িতাম। আমাদের অভিভাবকের ইচ্ছা ছিল আমাদিগকে সহসা সর্ববিদ্যায় পারদশী করিয়া তুলিবেন । র্তাহার অভিপ্ৰায় কতদূর সফল হইয়াছে র্যাহারা আমাদিগকে জানেন তঁহাদের নিকট প্রকাশ করা বাহুল্য এবং র্যাহারা জানেন না তঁহাদের নিকট গোপন করাই শ্রেয় ! তাহার পর বহুকাল অতীত হইয়াছে । ইতিমধ্যে সেই ঘর হইতে কঙ্কাল এবং আমাদের মাথা হইতে অস্থিবিদ্যা কোথায় স্থানান্তরিত হইয়াছে অন্বেষণ করিয়া জানা যায় না । অল্পদিন হইল একদিন রাত্রে কোনো কারণে অন্যত্র স্থানাভাব হওয়াতে আমাকে সেই ঘরে শয়ন করিতে হয় - অনভ্যাসবশত ঘুম হইতেছে না। এপাশি-ওপাশ করিতে করিতে গির্জার ঘড়িতে বড়ো বড়ো ঘণ্টাগুলো প্ৰায় সব কটা বাজিয়া গেল । এমন সময়ে ঘরের কোণে যে তেলের সেজ জ্বলিতেছিল সেটা প্ৰায় মিনিট-পাঁচেক ধরিয়া খাবি খাইতে খাইতে একেবারে নিবিয়া গেল। ইতিপূর্বেই আমাদের বাড়িতে দুই-একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে। তাই এই আলো নেবা হইতে সহজেই মৃত্যুর কথা মনে উদয় হইল । মনে হইল। এই-যে রাত্রি দুই প্রহরে একটি দীপশিখা চিরান্ধকারে মিলাইয়া গেল, প্রকৃতির কাছে ইহাও যেমন আর মানুষের ছোটাে ছোটাে প্ৰাণশিখা কখনো দিনে কখনো রাত্রে হঠাৎ নিবিয়া বিস্মৃত হইয়া যায়, তাহাও তেমনি । ক্ৰমে সেই কঙ্কালের কথা মনে পড়িল । তাহার জীবিতকালের বিষয় কল্পনা করিতে করিতে সহসা মনে হইল, একটি চেতন পদার্থ অন্ধকারে ঘরের দেয়াল হাতড়াইয়া আমার মশারির চারি দিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, তাহার ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দ শুনা যাইতেছে । সে যেন কী খুঁজিতেছে, পাইতেছে না এবং দ্রুততর বেগে ঘর্যময় প্ৰদক্ষিণ করিতেছে । নিশ্চয় বুঝিতে পারিলাম, সমস্তই আমার নিদ্রাহীন উষ্ণ মস্তিষ্কের কল্পনা এবং আমারই মাথার মধ্যে বো বেঁা করিয়া যে রক্ত ছুটিতেছে তাঁহাই দ্রুত পদশব্দের মতো শুনাইতেছে। কিন্তু, তবু গা ছমছম করিতে লাগিল । জোর করিয়া এই অকারণ ভয় ভাঙিবার জন্য বলিয়া উঠিলাম, ‘কেও ” পদশব্দ আমার মশারির কাছে আসিয়া থামিয়া গেল এবং একটা উত্তর শুনিতে পাইলাম, “আমি । আমার সেই কঙ্কালটা কোথায় গেছে তাই খুজিতে আসিয়াছি।” আমি ভাবিলাম, নিজের কাল্পনিক সৃষ্টির কাছে ভয় দেখানে কিছু নয়— পাশবালিশটা সবলে আঁকড়িয়া ধরিয়া চিরপরিচিতের মতো অতি সহজ সুরে বলিলাম, “এই দুপুর রাত্রে বেশ কাজটি বাহির করিয়াছ । তা, সে কঙ্কালে এখন আর তোমার আবশ্যক ?” অন্ধকারে মশারির অত্যন্ত নিকট হইতে উত্তর আসিল, “বল কী । আমার বুকের হাড় যে তাঁহারই মধ্যে ছিল । আমার ছবিবশ বৎসরের যৌবন যে তাহার চারি দিকে বিকশিত হইয়াছিল— একবার দেখিতে ইচ্ছা! করে না ?” আমি তৎক্ষণাৎ বলিলাম, ‘হী, কথাটা সংগত বটে । তা, তুমি সন্ধান করো গে যাও । আমি একটু ঘুমাইবার চেষ্টা করি ।” সে বলিল, “তুমি একলা আছ বুঝি ? তবে একটু বসি । একটু গল্প করা যাক। পয়ত্রিশ বৎসর পূর্বে আমিও মানুষের কাছে বসিয়া মানুষের সঙ্গে গল্প করিতাম। এই পঁয়ত্ৰিশটা বৎসর আমি কেবল শ্মশানের