পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী "לוסאל) মারিয়াছে। তাহারা হা-হা করিয়া ছুটিয়া আসিল । সকলে আসিয়া ফকিরকে জানাইয়া দিল, এমন ভণ্ডতপস্বীগিরি এখানে খাটিবে না । ভালোমানুষের ছেলের মতো কাল কাটাইতে হইবে । একজন বলিল, ‘ইনি তো পরমহংস নন, পরম বাক ৷” গাম্ভীৰ্য গোফদাড়ি এবং গলাবন্ধের জোরে ফকিরকে এমন-সকল কুৎসিত কথা কখনো শুনিতে হয় নাই । যাহা হউক, লোকটা পাছে আবার পালায় পাড়ার লোকেরা অত্যন্ত সতর্ক রহিল । স্বয়ং জমিদার ষষ্ঠীচরণের পক্ষ অবলম্বন করিলেন । V ফকির দেখিল এমনি কড়া পাহারা যে, মৃত্যু না হইলে ইহারা ঘরের বাহির করিবে না। একাকী ঘরে বসিয়া গান গাহিতে লাগিল শোন সাধুর উক্তি, কিসে মুক্তি সেই সুযুক্তি কর গ্রহণ । বলা বাহুল্য, গানটার আধ্যাত্মিক অৰ্থ অনেকটা ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে । এমন করিয়াও কোনোমতে দিন কাটিত । কিন্তু মাখনের আগমনসংবাদ পাইয়া দুই স্ত্রীর সম্পর্কের এক বঁটাক শ্যালা ও শ্যালী আসিয়া উপস্থিত হইল । তাহারা আসিয়াই প্ৰথমত ফকিরের গোফদাড়ি ধরিয়া টানিতে লাগিল ; তাহারা বলিল, এ তো সত্যকার গোফদাড়ি নয়, ছদ্মবেশ করিবার জন্য আঠা দিয়া জুড়িয়া আসিয়াছে। নাসিকার নিম্নবতী, গুম্ফ ধরিয়া টানাটানি করিলে ফকিরের ন্যায় অত্যন্ত মহৎ লোকেরও মাহাত্ম্য রক্ষা করা দুষ্কর হইয়া উঠে । ইহা ছাড়া কানের উপর উপদ্রবও ছিল— প্রথমত মলিয়া, দ্বিতীয়ত এমন-সকল ভাষা প্রয়োগ করিয়া যাহাতে কান না মলিলেও কান লাল হইয়া উঠে । ইহার পর ফকিরকে তাহারা এমন-সকল গান ফর্মায়েশ করিতে লাগিল, আধুনিক বড়ো বড়ো নুতন পণ্ডিতেরা যাহার কোনোরূপ আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা করিতে হার মানেন । আবার নিদ্রাকালে তাহারা ফকিরের স্বল্পাবশিষ্ট গণ্ডস্থলে চুনকালি মাখাইয়া দিল ; আহারকালে কোসুরের পরিবর্তে কচু, ডাবের জলের পরিবর্তে ইকার জল, দুধের পরিবর্তে পিঠালি-গোলার আয়োজন করিল ; পিড়ার নীচে সুপারি রাখিয়া তাহাকে আছাড় খাওয়াইল ; লেজ বানাইল এবং সহস্র প্রচলিত উপায়ে ফকিরের অভ্ৰভেদী গাভীর্য ভূমিসাৎ করিয়া দিল । ফকির রাগিয়া ফুলিয়া-ফ্ৰাপিয়া বঁাকিয়া-ইকিয়া কিছুতেই উপদ্রবকারীদের মনে ভীতির সঞ্চার করিতে পারিল না । কেবল সর্বসাধারণের নিকট অধিকতর হাস্যাম্পদ হইতে লাগিল । ইহার উপরে আবার অন্তরাল হইতে একটি মিষ্ট কণ্ঠের উচ্চহাস্য মাঝে মাঝে কৰ্ণগোচর হইত ; সেটা যেন পরিচিত বলিয়া ঠেকিত এবং মন দ্বিগুণ অধৈৰ্য হইয়া উঠিত । পরিচিত কণ্ঠ পাঠকের অপরিচিত নহে। এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, ষষ্ঠীচরণ কোনো-এক সম্পর্কে হৈমবতীর মামা । বিবাহের পর শাশুড়ির দ্বারা নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া পিতৃমাতৃহীনা হৈমবতী মাঝে মাঝে কোনো-না-কোনো কুটুম্ববাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করিত । অনেকদিন পরে সে মামার বাড়ি আসিয়া নেপথ্য হইতে এক পরামকৌতুকাবহ অভিনয় নিরীক্ষণ করিতেছে। তৎকালে হৈমবতীর স্বাভাবিক রঙ্গপ্রিয়তার সঙ্গে প্ৰতিহিংসাপ্রবৃত্তির উদ্রেক হইয়াছিল কি না চরিত্রতত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতেরা স্থির করিবেন, আমরা বলিতে অক্ষম। ঠাট্টার সম্পৰ্কীয় লোকেরা মাঝে মাঝে বিশ্রাম করিত, কিন্তু মেহের সম্পৰ্কীয় লোকদের হাত হইতে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন । সাত মেয়ে এবং এক ছেলে তাহাকে এক দণ্ড ছাড়ে না । বাপের স্নেহ অধিকার করিবার জন্য তাহদের মা তাহাদিগকে অনুক্ষণ নিযুক্ত রাখিয়াছিল । দুই মাতার মধ্যে আবার রেষারেষি ছিল, উভয়েরই চেষ্টা যাহাতে নিজের সন্তানই অধিক আদর পায় । উভয়েই নিজ নিজ সন্তানদিগকে সর্বদাই উত্তেজিত করিতে লাগিল- দুই দলে মিলিয়া পিতার গলা জড়াইয়া ধরা, কোলে বসা, মুখচুম্বন করা প্রভৃতি প্ৰবল স্নেহব্যক্তিকার্যে পরস্পরকে জিতিবার চেষ্টা করিতে লাগিল । পারিত না । শিশুরা ভক্তি করিতে জানে না, তাহারা সাধুত্বের নিকট অভিভূত হইতে শিখে নাই, এইজন্য