পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

@ 8եr রবীন্দ্র-রচনাবলী মধ্যেও তার বিভাগের অন্ত নেই। বস্তুত নিজেকে সকলের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করবার জন্যেই সে নিয়মের বেড়া নির্মাণ করেছিল । বৌদ্ধধর্ম ভারতবষীয়কে সকলের সঙ্গে অবাধে মিলিয়ে দিচ্ছিল, বর্তমান হিন্দুধর্মের সমস্ত নিয়মসংযম প্রধানত তারই প্রতিকারের প্রবল চেষ্টা । সেই চেষ্টাটি আজ পর্যন্ত রয়ে গেছে। সে কেবলই দূর করছে, কেবলই ভাগ করছে, নিজেকে কেবলই সংকীর্ণ বদ্ধ করে আড়াল করে রাখবার উদ্যোগ করছে। হিন্দুর ধর্ম যেখানে, সেখানে বাহিরের লোকের পক্ষে সমস্ত জানলা-দরজা বন্ধ এবং ঘরের লোকের পক্ষে কেবলই বেড়া এবং প্রাচীর । অন্য দেশে অন্য জাতির মধ্যে স্বাতন্ত্র্যরক্ষার জন্যে কোনো চেষ্টা নেই তা বলতে পারি নে। কারণ, স্বাতন্ত্র্যরক্ষার প্রয়োজন আছে, সে প্রয়োজনকে অস্বীকার করা কোনোমতেই চলে না । কিন্তু অন্যত্র এই স্বাতন্ত্র্যরক্ষার চেষ্টা রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক অর্থাৎ এই চেষ্টাটা সেখানে নিজের নীচের তলায় বাস করে । মিলনের বৃত্তিটি স্বাতন্ত্র্যচেষ্টার উপরের জিনিস। ক্রীতদাস রাজাকে খুন করে সিংহাসনে চড়ে বসলে যেমন হয়, স্বাতন্ত্র্যচেষ্টা তেমনি মিলনধর্মকে একেবারে অভিভূত করে দিয়ে তার উপরে যদি আপনার স্থান দখল করে বসে, তা হলে সেইরকমের অন্যায় ঘটে । এইজন্যেই পারিবারিক বা সামাজিক বা রাষ্ট্ৰীয় স্বাৰ্থ বুদ্ধি মানুষকে স্বাতন্ত্র্যের দিকে টেনে থাকলেও, ধর্মবুদ্ধি তার উপরে দাড়িয়ে তাকে বিশ্বের দিকে— বিশ্বমানবের দিকে নিয়ন্ত আহবান করে । আমাদের দেশে বর্তমানকালে সেইখানেই ছিদ্র হয়েছে এবং সেই ছিদ্রপথেই এ দেশের শনি প্ৰবেশ করেছে। যে ধর্ম মানুষের সঙ্গে মানুষকে মেলায়, সেই ধর্মের দোহাই দিয়েই আমরা মানুষকে পৃথক করেছি। হয় । বন্ধনকে ছেদন করাই যার কাজ, তাকে দিয়েই আমরা বন্ধনকে পাকা করে নিয়েছি- তা হলে আজ আমাদের উদ্ধার করবে কে । আশ্চর্য ব্যাপার এই উদ্ধার করবার ভার আজ আমরা তারই হাতে দিতে চেষ্টা করছি, যে-জিনিসটা ধনেচেয়ে নিচেকার । আমরা স্বােজাত্য বুদ্ধির উপর বরাত দিয়েছি, ভারতবর্ষের অন্তৰ্গত মানুষের সঙ্গে মানুষকে মিলিয়ে দেবার জন্যে । আমরা বলছি, তা না হলে আমরা বড়ো হব না, বলিষ্ঠ হব না, আমাদের প্রয়োজন সিদ্ধি হবে না । আমরা ধর্মকে এমন জায়গায় এনে ফেলেছি যে, আমাদের জাতীয় স্বাৰ্থ বুদ্ধি প্রয়োজনবুদ্ধিও তার চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে ! এমন দশা হয়েছে যে, ধর্মে আমাদের উদ্ধার নেই, স্বাজাত্যের দ্বারা আমাদের উদ্ধার পেতে হবে !! এমন হয়েছে যে, ধর্ম আমাদের পৃথক থাকতে বলছে, স্বােজাত্য আমাদের এক হবার জন্যে তাড়না করছে ! কিন্তু ধর্মবুদ্ধি যে মিলনের ঘটক নয়, সে মিলনের উপর আমি ভরসা রাখতে পারি নে। ধর্মমূলক মিলনতত্ত্বটিকে আমাদের দেশে যদি প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তবেই স্বভাবতই আমরা মিলনের দিকে যাব, কেবলই গণ্ডি আঁকবার এবং বেড়া তোলবার প্রবৃত্তি থেকে আমরা নিস্কৃতি পাব । ধর্মের সিংহদ্বার খোলা থাকলে তবেই ছোটাে বড়ো সকল যজ্ঞের নিমন্ত্রণেই মানুষকে আমরা আহবান করতে পারব।-- নতুবা কেবলমাত্র প্রয়োজনের বা স্বােজাত্য-অভিমানের খিড়কির দরজাটুকু যদি খুলে রাখি, তবে ধর্মনিয়মের বাধা অতিক্রম করে সেই ফাকিটুকুর মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের এত প্ৰভেদপার্থক্য, এত বিরোধবিচ্ছেদ গলতে পারবে না- মিলতে পারবে না । ধর্মান্দোলনের ইতিহাসে এইটি বরাবর দেখা গেছে, ধর্ম যখন আপনার রসের মূর্তি প্রকাশ করে তখনই সে বাধন ভাঙে এবং সকল মানুষকে এক করবার দিকে ধাবিত হয় । খ্রীস্ট যে প্রেমভক্তিরসের বন্যাকে মুক্ত করে দিলেন, তা য়িহুদিধর্মের কঠিন শাস্ত্ৰবন্ধনের মধ্যে নিজেকে বদ্ধ রাখতে পারলে না এবং সেই ধর্ম আজ পর্যন্ত প্ৰবল জাতির স্বার্থের শৃঙ্খলকে শিথিল করবার জন্য নিয়ত চেষ্টা করছে, আজ পর্যন্ত সমস্ত সংস্কার এবং অভিমানের বাধা ভেদ করে মানুষের সঙ্গে মানুষকে মেলাবার দিকে তার আকর্ষণশক্তি প্রয়োগ করছে । বৌদ্ধধর্মের মূলে একটি কঠোর তত্ত্বকথা আছে কিন্তু সেই তত্ত্বকথায় মানুষকে এক করে নি ; তার মৈত্রী তার করুণা এবং বুদ্ধদেবের বিশ্বব্যাপী হৃদয়প্রসারই মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রভেদ ঘুচিয়ে দিয়েছে। নানক