পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዕዮ (፩ O রবীন্দ্র-রচনাবলী কিন্তু ঝরনার যে গতি সে তার নিজেরই গতি— সেইজন্যে এই গতিতেই তার ব্যাপ্তি, মুক্তি, তার সৌন্দৰ্য । এইজন্য গতিপথে সে যত আঘাত পায় ততই তাকে বৈচিত্র্য দান করে । বাধায় তার ক্ষতি নেই, চলায় তার শ্রান্তি নেই । মানুষের মধ্যেও যখন রসের আবির্ভাব না থাকে, তখনই সে জড়পিণ্ড । তখন ক্ষুধা তৃষ্ণা ভয় ভাবনাই তাকে ঠেলে ঠেলে কাজ করায়, সে কাজে পদে পদেই তার ক্লান্তি । সেই নীরস অবস্থাতেই মানুষ অস্তরের নিশ্চলতা থেকে বাহিরেও কেবলই নিশ্চলত বিস্তার করতে থাকে । তখনই তার যত খুঁটিনাটি, যত আচার বিচার, যত শাস্ত্ৰ শ্বাসন । তখনই মানুষের মন গতিহীন বলেই বাহিরেও সে আষ্ট্রেপৃষ্ঠে বদ্ধ । তখনই তার ওঠাবসা খাওয়াপরা সকল দিকেই বাধাৰ্বিাধি । তখনই সে সেই-সকল নিরর্থক কর্মকে স্বীকার করে যা তাকে সম্মুখের দিকে অগ্রসর করে না, যা তাকে অন্তহীন পুনরাবৃত্তির মধ্যে কেবলই একই জায়গায় ঘুরিয়ে মারে । রসের আবির্ভাবে মানুষের জড়ত্ব ঘুচে যায় । সুতরাং তখন সচলতা তার পক্ষে অস্বাভাবিক নয় ; তখন অগ্রগামী গতিশক্তির আনন্দেই সে কর্ম করে, সর্বজয়ী প্রাণশক্তির আনন্দেই সে দুঃখকে স্বীকার করে । বস্তুত মানুয্যের প্রধান সমস্যা এ নয় যে, কোন শক্তি দ্বারা সে দুঃখকে একেবারে নিবৃত্ত করতে পারে । তার সমস্যা হচ্ছে এই যে, কোন শক্তি দ্বারা সে দুঃখকে সহজেই স্বীকার করে নিতে পারে । দুঃখকে নিবৃত্ত করবার পর যারা দেখাতে চান, তারা অহংকেই সমস্ত অনার্থের হেতু বলে একেবারে তাকে বিলুপ্ত করতে বলেন ; দুঃখকে স্বীকার করবার শক্তি র্যারা দিতে চান, তঁরা অহংকে প্রেমের দ্বারা পরিপূর্ণ করে তাকে সার্থক করে তুলতে বলেন । অর্থাৎ গাড়ি থেকে ঘোড়াকে খুলে ফেলাই যে গাড়িকে খানায় পড়া থেকে রক্ষা করবার সুকৌশল তা নয়, ঘোড়ার উপরে সারথিকে স্থাপন করাই হচ্ছে গাড়িকে বিপদ থেকে বঁাচানো এবং তাকে গম্যস্থানের অভিমুখে চালানোর যথোচিত উপায় । এইজন্যে মানুষের ধর্মসাধনার মধ্যে যখন ভক্তির আবির্ভাব হয়, তখনই সংসারে যেখানে যা-কিছু সমস্ত বজায় থেকেও মানুষের সকল সমস্যার মীমাংসা হয়ে যায়- তখন কর্মের মধ্যে সে আনন্দ ও দুঃখের মধ্যে সে গৌরব অনুভব করে ; তখন কমাই তাকে মুক্তি দেয় এবং দুঃখ তার ক্ষতির কারণ হয় না । গুহাহিত উপনিষৎ তাকে বলেছেন— গুহাহিত্যং গহবরেণ্ঠং— অর্থাৎ তিনি গুপ্ত, তিনি গভীর । তাকে শুধু বাইরে দেখা যায় না, তিনি লুকানো আছেন । বাইরে যা-কিছু প্ৰকাশিত, তাকে জানিবার জন্যে আমাদের ইন্দ্ৰিয় আছে- তেমনি যা গুঢ়, যা গভীর, তাকে উপলব্ধি করবার জন্যেই আমাদের গভীরতর অন্তরিান্দ্ৰিয় আছে। তা যদি না থাকত তা হলে সেদিকে আমরা ভুলেও মুখ ফিরাতুম না ; গহনাকে পাবার জন্যে আমাদের তুষ্ণার লেশও থাকত না । এই অগোচরের সঙ্গে যোগের জন্যে আমাদের বিশেষ অন্তরিান্দ্ৰিয় আছে রিলেই মানুষ এই জগতে জন্মলাভ করে কেবল বাইরের জিনিসে সন্তুষ্ট থাকে নি । তাই সে চারি দিকে খুঁজে খুঁজে মরছে, দেশবিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাকে কিছুতে থামতে দিচ্ছে না । কোথা থেকে সে এই খুঁজে বের করবার পরোয়ানা নিয়ে সংসারে এসে উপস্থিত হল ? যা-কিছু পাচ্ছি, তার মধ্যে আমরা সম্পূৰ্ণকৈ পাচ্ছি নে— যা পাচ্ছি নে, তার মধ্যেই আমাদের আসল পাবার সামগ্ৰীটি আছে, এই একটি সৃষ্টিছাড়া প্ৰত্যয় মানুষের মনে কেমন করে জন্মল ? পশুদের মনে তো এই তাড়নাটি নেই। উপরে যা আছে তারই মধ্যে তাদের চেষ্টা ঘুরে বেড়াচ্ছে— মুহুর্তকালের জন্যেও তারা এমন কথা মনে করতে পারে না যে যাকে দেখা যায় না। তাকেও খুঁজতে হবে, যাকে পাওয়া যায় না। তাকেও লাভ করতে হবে । তাদের ইন্দ্ৰিয় এই বাইরে এসে থেমে গিয়েছে, তাকে অতিক্রম করতে পারছে না বলে তাদের মনে কিছুমাত্র বেদনা নেই ।